You are currently viewing গ্রন্থঃ রেখায়ন

গ্রন্থঃ রেখায়ন

সম্পাদনাঃ শওকত আহসান ফারুক, ফখরুল ইসলাম রচি এবং রেজা সেলিম

প্রকাশকঃ বিদ্যাপ্রকাশ

গ্রন্থ পরিচিতিঃ আদনান সৈয়দ

সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী বেশ কিছুদিন শুধুমাত্র স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, জীবনী, ব্যক্তিগত জার্নাল, ইতিহাস এসব গ্রন্থ নিয়ে গ্রন্থ পাঠ প্রতিক্রিয়া/আলোচনা/বই পরিচিতি লিখবো। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ধারার বইগুলো পাঠ করলে মনে হয় টাইম মেশিনে চড়ে খুব দ্রুত নির্দিষ্ট একটি সময়ে বিনে পয়সায় ঘুরে আসা যায়। জানা সেই সময়ের রাজনীতি, শিল্পের নানা রকম আঁকাবাঁকা গতিপথ আর শিল্পসৃষ্ট নানা রকম অলিগলির পদচিহৃ। এই ধারায় আমার আজকের নির্বাচিত বই ‘রেখায়ন’। ‘রেখায়ন’ সম্পর্কে যাঁদের খুব একটা ধারণা নেই তাঁদের জন্য দুটো কথা আগেই বলে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।  ‘রেখায়ন’ মূলত ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি নাম্বার প্লেট, সাইনবোর্ড আর ব্যানারের দোকানের নাম। কিন্তু এই দোকানটিই একসময় ধীরে ধীরে ঢাকার শিল্প-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বদের একটি আড্ডার লোভনীয় জায়গা হয়ে উঠে। সদ্য স্বাধীন দেশে একদল তরুণদের উচ্ছাস, উদ্যম, স্বপ্ন আর উদ্দীপনার ফসল এই ‘রেখায়ন’।  প্রথম দিকে খুব সাদামাটা করে শুরু হলেও পরবর্তীতে এই ‘রেখায়ন’ হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশে সেই সত্তর, আশি এবং নব্বই দশকেও এমন কোনো শিল্পী, কবি, সাহিত্যিককে  খুঁজে পাওয়া যাবে না যাঁরা এই ‘রেখায়নে’ আড্ডা দেননি, সেখানে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘন্টার ঘন্টার সময় কাটাননি। ঢাকা কেন্দ্রিক শিল্প-সাহিত্যিক-কবি, চিত্র নির্মাতাসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষের আড্ডার জায়গা  ছিলো এই রেখায়ন। ঢাকার ‘বিউটি বোর্ডিং’ এ আড্ডার মত ‘রেখায়ন’ হয়ে উঠেছিল শিল্প-সংস্কৃতির মানুষদের আড্ডার কেন্দ্র বিন্দু।

কিন্তু কীভাবে হয়ে উঠলো এই ‘রেখায়ন’? এর পেছনের গল্পটাই বা কী? কীভাবে একজন ছাত্র মাত্র সোয়া তিন টাকা দিয়ে একটি কালি ও একটি সাদা রঙের কৌটা কিনে শাহবাগ বিপণি বিতানের পশ্চিম পাশে ল্যাম্পপোস্টের  এক কোনায় ‘এখানে বাংলায় গাড়ির নম্বর প্লেট লেখা হয়’ সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে শুরুটা করেছিলেন, সেই নিয়ে সুন্দর একটি লেখা লিখেছেন রেখায়নের মূল চালিকা শক্তি শিল্পী রাগীব আহসান। ‘ল্যাম্পপোস্ট থেকে রেখায়ন’ এই শিরনামে এই লেখায় পাওয়া যাবে রেখায়নকে নিয়ে বিস্তারিত ইতিহাস। সেই লেখায় আবিস্কার করা যাবে ‘রেখায়ন’ কীভাবে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অনিবার্য একটি শ্লোগানে পরিনত হয়েছিলো। সেকারণে শিল্পী রাগীব আহসান হয়তো যথার্থই লিখেছেন, ‘রেখায়ন নামের এই গ্রন্থটি একটি সময়ের প্রক্ষেপণ’।

শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবসময় বলতেন, ‘ Art is not a pleasure trip, it’s a battle’ কথাটা কতই না সত্য! ‘রেখায়ন’ এর ইতিহাস পাঠ করলে সেই সত্যটি আরো প্রকটভাবে আমাদের সামনে ধরা দেয়। রাগীব আহসান লিখছেন,

 ‘১৯৭৮ সালে, কয়েকজন মিলে চিন্তা করলাম হাতে বানানো ঈদ কার্ড বিক্রি করব। লুৎফুল ভাই, মন্টু সাথে সাথে রাজ হযে গেল। রোজা শুরু হতেই সবাই বসে যাই কার্ড নিয়ে। আমাদের স্লোগান ছিলো, প্রয়োজনে ক্রেতার চাহিদা মাফিক কার্ড বানিয়ে দিব। তের জন পঞ্চাশ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ফান্ড রেইজ করেছিলাম। সেই টাকা দিয়ে কাগজ, কলম, রং কিনে আনি নিউমার্কেট থেকে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কার্ডের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। কবি শিহব সরকার সচিত্র সন্ধানীতে পত্রিকা কার্ড নিয়ে ফিচার করেছিল। কচি ভাই, মন্টু, আমি, ফাউজুল কবির, মহসীন খান, আমানুল্লাহ সিদ্দিকী কচিভাই, অলকেশসহ আরো আরো শিল্পী। পরবর্তীতে শল্পীদের নামের তালিকায় যোগ হয় সৈয়দ আহমদ তারেক, ফখরুল ইসলাম কচি, রাগীব উদ্দিন আহমেদ, মাসুক হেলাল।’

চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি, সিনেমার নায়ক নায়িকা থেকে শুরু করে রাজনীতিবীদ, সরকারের বড় আমলা কে যোগ দিতো না এই আড্ডায়? এখানে যেমন আড্ডা দিতে আসতেন আহমদ ছফা, কবি রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, অরুণাভ সরকার, নির্মলেন্দু গুণ, বিপ্র্রদাশ বড়ুয়া, অসীম সাহা, রবীন্দ্র গোপ, তুষার দাশ, মোস্তফা আনোয়ার, সিরাজুল ইসলামসহ বিশাল লম্বা কবি- সাহিত্যিকের দল পাশাপাশি আসতেন আফজাল হোসেন, অলকেশ ঘোষ, চিত্রগ্রাহক মনোয়ার হোসেন, পাভেল রহমান, শিল্পী মহসীন খান, শিল্পী ইমরুল চৌধুরীসহ অসংখ্য শিল্পীরাও। তাঁদের সবার আাড্ডার ইতিহাস এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়  খোদাই করে লেখা রয়েছে।

‘রেখায়ন’কে নানাভাবে মূল্যায়ন করে, নানা দৃষ্টিকোন থেকে স্মৃতিচারণ করে মোট ২৮টি নিবন্ধ/স্মৃতিচারণ এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এখানে লিখেছেন হাফিজুর রহমান, ড.আলী রিয়াজ, প্রবীর বিকাশ সরকার, মুস্তাফা মহিউদ্দীন, শাব্বির সরকার, ড. মাহবুব হাসান, আবু বকর, সৈয়দ আহমদ তারেক, পল্লল ভট্টাচার্য, মাহ্ফুজা শীলু, শামীম আজাদ, বিদ্যুৎ সরকার, আনোয়ারুল হক, রেজা সেলিম, শওকত আহসান ফারুক, অরুণ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফরিদ মুজহার, রোকসানা লেইস, শাহজাহান চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, কাজি জাকির হাসান চন্দন, সাইফুল আহসান বুলবুল, কায়সার আহমেদ, সাঈদ হোসেন এবং কাজী সুফিয়া আখতার।

২৯২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন রেখায়নের স্রষ্ঠা শিল্পী রাগীব আহসান।

অভিনন্দন বিদ্যাপ্রকাশকে। অসাধারণ মূল্যবান এই গ্রন্থটি বর্তমান সময়তো বটেই ভবিষ্যত প্রজন্মদের জন্যও একটি ঐতিহাসিক দলিল বলে মনে করি। এই গ্রন্থপাঠে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের শিল্প এবং সাহিত্যের নানান বাঁক যেমন জানা যাবে পাশাপাশি ‘রেখায়ন’কে ঘিরে একদল ক্ষুদার্ত শিল্পীদের আড্ডার চিত্রটিও চোখের সামনে ঠিক দুলে উঠবে।

অভিনন্দন ত্রয়ী সম্পাদক শওকত আহসান ফারুক, ফখরুল ইসলাম রচি এবং রেজা সেলিমকে।

বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি এবং একই সঙ্গে গ্রন্থটি পাঠকের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াক সেই প্রত্যাশাও করছি। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইয়ের বাংলা বইয়ের দোকান এবং অনলাইনে রকমারিসহ নানা রকম বইয়ের ওয়েব জিন থেকে ‘রেখায়ন’ গ্রন্থটি সংগ্রহ করা যাবে।

গ্রন্থটির মূদ্রিত মূল্য সাত শত টাকা।

হেপি রিডিং!

Leave a Reply