You are currently viewing গ্রন্থ :চেনা অচেনা শহীদ কাদরী

গ্রন্থ :চেনা অচেনা শহীদ কাদরী

লেখক: আদনান সৈয়দ

প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স।

বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন হাসান ফেরদৌস

চেনা অচেনা শহীদ কাদরী গ্রন্থটি কবির প্রথম ও একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনী। বাংলা ভাষায় হাতেগোনা কয়েকজন প্রধান কবি/লেখক ছাড়া অন্য কারো পূর্ণাঙ্গ জীবনী কার্যত নেই। তাঁদের কবিতা নিয়ে গবেষণা হয়েছে, কেউ কেউ পিএইচডিও করেছেন, কিন্তু সন-তারিখ মেনে কালক্রমানুসারী জীবনীগ্রন্থ আছে বলে আমি জানি না। এমনকি আমাদের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানকে নিয়েও কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ নেই। সেদিক দিয়ে চেনা অচেনা শহীদ কাদরী গ্রন্থটি জীবনচরিত সাহিত্য ধারায় একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন।

গ্রন্থটি রচিত হয়েছে কবির মৃত্যুর অতি অব্যবহিত পরেই। লিখেছেন এমন একজন যিনি কবিকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, তাঁর জীবনের শেষ দশ-বারো বছর নিত্যদিনের বৈঠকি আড্ডার ভেতর দিয়ে। কবি ঢাকায় তাঁর বন্ধুদের কাছে পরিচিত তুখোড় আড্ডাবাজ হিসেবে। প্রবাসে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের পর, সেই সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হন প্রথম পঁচিশটি বছর। বস্টন থেকে ২০০৪ সালে স্থায়ীভাবে নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করলে কবি ফিরে যান তাঁর যৌবনের দিনযাপনের অভ্যাসে। তখন থেকেই তিনি দুরারোগ্য বৃক্ক রোগে আক্রান্ত, চলাচলের সুযোগ সীমিত। ফলে নিজ গৃহের আরামসোফায় বসেই চলত আড্ডা। আদনান ছিলেন সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। বয়সের ব্যবধান তো ছিল, তদুপরি ছিল সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার কৃত্রিম ব্যবধান। শহীদ কাদরী সে ব্যবধান কখনোই মানেননি, ফলে সেই ব্যবধান অতিক্রম করা অসম্ভব হয়নি আড্ডার সদস্যদের। আদনানও পেরেছিল। এই গ্রন্থ কবির প্রতি তরুণ এক লেখকের আনত শ্রদ্ধা, তার আভাসটি প্রচ্ছন্ন, তবে কবির জীবনের কম আলোকিত দিক সমূহ – এমনকি বিতর্কিত অধ্যায় সমূহ – উদ্ধারেও তিনি বিরত হননি, তা থেকে জীবনীগ্রন্থের গবেষক হিসেবে তাঁর নিষ্ঠার প্রমাণ দুর্লক্ষ্য নয়।

শহীদ কাদরীর জন্ম কলকাতায় ১৯৪২ সালে। শৈশবের মাত্র দশ বছর শহরটিতে তিনি কাটান, অথচ সেই শহরের স্মৃতি তিনি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। একথা বলা সম্ভবত ভুল হবে না যে কলকাতার জন্যই এক ধরনের খ-িত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তিনি লালন করেছেন। অভিজাত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম, ভালোভাবে বাংলা শেখার আগে তিনি শিখেছেন উর্দু ও ইংরেজি। আদ্যোপান্ত নাগরিক, শহুরে জীবনের আলো ও অন্ধকার দুটোই তাঁর দেখা। তাঁর কবিতায় কখনো যে নেতিবোধ নজরে আসে, অথবা আরো স্পষ্ট করে বললে, পাপচেতনার যে প্রকাশ দেখি, তা সম্ভবত কলকাতার কারণেই। এর কিছুটা যাপিত, কিছুটা স্মরিত, তবে অধিকাংশই কল্পিত। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য আমার, আদনানের নয়।

কলকাতা, বিশেষত যে গৃহে তাঁর শৈশব কেটেছে, তার প্রতি শহীদ কাদরী কতটা কাতর, জীবনসায়াহ্নে এসেও তার প্রমাণ মেলে গ্রন্থভুক্ত একটি উদ্ধৃতি থেকে। ১৯৫২ সালে যেদিন কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন কবি, সেকথা স্মরণ করে তিনি আদনানকে বলেছেন :

‘সবাই ট্যাক্সিতে উঠতে যাবে ঠিক তখন আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। আমার এই প্রিয় বাড়িটি ছেড়ে চলে যেতে হবে? আর কখনো এই বাড়িতে আসব না? এসব ভাবতে ভাবতেই এক দৌড়ে চলে গেলাম বাড়ির প্রিয় আঙ্গিনাটার সামনে। তারপর বাড়িটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার এক দৌড়ে বড় বড় সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উঠে গেলাম দোতালায় চিরচেনা ছোট্ট চিলেকোঠায় যেখানে আমি থাকতাম। সেই ঘরের প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে চক দিয়ে বড় বড় করে নিজের নাম লিখলাম শহীদ কাদরী, শহীদ কাদরী।’

আদনানের গ্রন্থটির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো এই রকম অসংখ্য ছোটখাটো ব্যক্তিগত স্মৃতির রোমন্থন। অধিকাংশই কবির নিজ মুখে শোনা, কোনো কোনোটা বা তাঁর নিকট কোনো বন্ধুর বয়ানিতে। কেমন বৈপরীত্যে ভরা তাঁর জীবন, এই অন্তরঙ্গ গল্প-কথায় তাঁর একটি কৌতূহলোদ্দীপক চিত্র প্রকাশিত হয় এই গ্রন্থে। মানুষ শহীদ কাদরীকে বুঝতে এই টুকরো গল্পগুলো আমাদের সাহায্য করে। যেমন, ঢাকায় তাঁর শৈশবের এই গল্পটি। একদিন শহীদ কাদরী আবিষ্কার করলেন তাঁদের বাসার গৃহভৃত্যটি বাজারের পয়সা থেকে কিছু আধুলি-সিকি মেরে দিচ্ছে।

‘প্রথমে ভাবলাম ভাইয়াকে (কবির বড় ভাই শাহেদ কাদরী) বলি। হঠাৎ মাথায় দুষ্ট একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ঘটনাটা বলে দিলে তো সব শেষ, সে বাজারের পয়সা চুরি করে জমালে সেটাতো আমারই লাভ! আমি সাথে সাথে পুরো বিষয়টা চেপে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। সে চুরি করে জমায় আর আমি যখন তখন লুকিয়ে সেখান থেকে তার চুরির ধনে হাত দিতে শুরু করি। একদিন বিষয়টা ভাইয়া কীভাবে জানি জেনে গেল। আমিতো ধরা পড়লামই, চাকরটাও ধরা পড়লো।’

শহীদ কাদরী ধীমান ও শিক্ষিত কবি হিসেবে তাঁর সমসাময়িক বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন। এজন্য তাঁকে প্রস্তুত হতে হয়েছিল। নিয়মমাফিক স্কুলে পাঠ গ্রহণ তাঁর বেশিদূর এগোয়নি, কিন্তু অনতি-কিশোর বয়স থেকেই বইকে তিনি নিত্যসঙ্গী করেছিলেন। এ কাজে তাঁকে বলতে গেলে হাত ধরে পথ শিখিয়েছেন শাহেদ কাদরী। কবির নিজের জবানিতে সে স্বীকৃতি এই গ্রন্থে রয়েছে।

ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘প্রিকশাস’ – সোজা বাংলায় ডেপো – শহীদ কাদরী ছিলেন সেরকম একজন। মাত্র তেরো বছর বয়সে স্পন্দন পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রথম কবিতা। চৌদ্দ বছর বয়সে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর কবিতা ‘এই শীতে’। তাতে এ-রকম একটি আকস্মিক বাক্য ‘বসন্তের শিথিল স্তন নিঃশেষে পান করে নিঃস্বার্থ মাটি’, আমাদের ইঙ্গিত দেয় চেনাপথ ধরে হাঁটার মানুষ যে তিনি নন, কাব্যচর্চার ঊষালগ্ন থেকেই তাঁর প্রমাণ রয়েছে। বস্তুত, তাঁর কবিতার আধুনিকতা ঠিক প্রথাগত বাংলা কবিতার হাত ধরে আগমন ঘটেনি, ঘটেছে মুখ্যত পশ্চিম ইউরোপীয় কবিতাকে আশ্রয় করে। এই গ্রন্থে জানতে পারি ফরাসি কবি ত্রিস্তঁজারার একটি কবিতা পড়ে কবিতার আরেক চেহারা আবিষ্কার করেন শহীদ কাদরী। ‘তখন থেকেই ভাবতে শুরু করি যে কবিতা শুধু সুন্দরের বন্দনা হতে পারে না। কবিতার ক্ষেত্র আরো ব্যাপক।’ (আদনান জানিয়েছেন, জারার যে কবিতাটি কবিকে প্রভাবিত করে তার নাম ‘মিরর অব ফ্রেঞ্চপোয়েট্রি’, কিন্তু এই নামে জারার কোনো কবিতা আমি খুঁজে পাইনি। সম্ভবত কবি এই নামের কোনো গ্রন্থের কথা বলে থাকবেন)।

শহীদ কাদরী সেই কৈশোরেই শামসুর রাহমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন এবং বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁরা দ্রুত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এই দুই কবির বন্ধুত্বের এই পর্বটি গভীর অভিনিবেশ নিয়ে পুনঃনির্মাণ করেছেন আদনান। শহীদ কাদরীর নিজস্ব বয়ান তো রয়েছেই আরো অনেক সমসাময়িক কবি ও বন্ধুদের বিবরণে এই দুই অসম বয়সী কবির বন্ধুত্ব ও অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য ভাষ্য উন্মোচিত হয় এই গ্রন্থে। শুধু শামসুর রাহমান নয়, সেই সময়ের অন্যান্য প্রধান কবি ও লেখক, যেমন আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, বেলাল চৌধুরী ও মাহমুদুল হক – তাঁদের সঙ্গেও নিকট-বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কবির। এই পর্বটি নির্মাণে আদনান এখন জীবিত এমন অনেক কবি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের ভাষ্যে সর্বদা কবির প্রতি যে শুধু প্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে তা নয়, কবিরপ্রতি কটু – এমনকি ঈর্ষাসূচক মন্তব্য আমাদের শুনতে হয়। আদনানের গ্রন্থটি যে শহীদ কাদরীর প্রতি একটি নিঃশর্ত প্রশস্তিগাথা নয়, এই বহুকৌণিক অবলোকন থেকে সেকথা ধরা পড়ে।

গ্রন্থটির অন্য বৈশিষ্ট্য, আদনান শহীদ কাদরীর কাব্যজীবন উদ্ধারের বদলে তাঁর মানবজীবন উদ্ধারেই অধিক আগ্রহী মনে হয়েছে। এটি গ্রন্থটির দুর্বলতা, সেটি তার শক্তিও বটে। অতিউৎসাহী কোনো নবীন কাব্যানুরাগীর হাতে পড়লে এই গ্রন্থ সম্ভবত শহীদ কাদরীর কবিতার একটি সন্দর্ভ হয়ে উঠত। আদনান সে পথ অনুসরণ করেননি, আমার বিবেচনায়, তাতে পাঠকের লাভ হয়েছে বেশি। কবির কাব্যপ্রতিভা উদ্ধারের জন্য প্রধান আশ্রয় তাঁর কবিতা। তাঁর লিখিত সব কবিতাই এখন হাতের কাছে রয়েছে। কিন্তু এই কবির জীবন, যার ভিত্তিভূমে রচিত হয়েছে এসব কবিতা, আমাদের কাছে তা যত পরিজ্ঞাত হবে, ততই উন্মুক্ত হবে তাদের অন্তর্গত বার্তা।

এই গ্রন্থের বৃহত্তর অংশে রচিত হয়েছে কবির প্রবাস জীবন – প্রথমে জার্মানি, পরে ইংল্যান্ড ও সবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতদিন এই পর্বের অনেক কিছুই

আলো-আঁধারিতে ঢাকা ছিল, বাস্তবের চেয়ে মিথ হয়ে উঠেছিল অধিক জনশ্রুত। প্রায় চার দশকের এই নির্বাসিত জীবন উদ্ধারে আদনান দ্বারস্থ হয়েছেন কবির স্ত্রী, পুত্র, নিকট-দূর বন্ধু-বান্ধবের। তাঁদের বয়ানিতে যে জীবনের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই, তা শুধু বিচিত্র ও বর্ণিল নয়, বেদনা ও আক্ষেপের এক নীরব মানচিত্রও বটে। বৃক্ক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর, শেষ জীবনে নীরা কাদরীর সঙ্গে প্রণয় ও বিবাহ কবিকে দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছিল। এ কেবল ব্যক্তিগত জীবনযাপন অর্থে নয়, শহীদ কাদরীর কাব্যিক সাফল্যের নিক্তিতেও। কবির চতুর্থ গ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও, প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল নীরা কাদরীর নিরন্তর সাহচর্য ও সমর্থনের কারণেই। এই সময়ে কবি ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’ নামে একটি ত্রৈ-মাসিক কাব্য সন্ধ্যার পৌরোহিত্য শুরু করেন। তাঁর এই দ্বিতীয় জন্মের প্রতিটি অধ্যায় বিপুল পরিশ্রমে উদ্ধার করে এনেছেন আদনান। শুধু পারিবারিক ও কর্মজীবন নয়, তাঁর কাব্যভাবনা ও সমকালীন কবিদের প্রতি তাঁর খোলামেলা মূল্যায়নও এতে রয়েছে। একটি সংক্ষিপ্ত জীবনাক্রম ও অসংখ্য দুর্লভ ছবি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

Leave a Reply