You are currently viewing ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি

ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি

লেখকঃ শাঁওলী মিত্র

প্রকাশকঃ এম.সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ কলকাতা

পাঠ প্রতিক্রিয়া আদনান সৈয়দ

মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার বই ‘ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি’। আকারে ছোট হলেও, বিষয় বৈচিত্র্য এবং ভাবনার দিক দিয়ে বইটি ছিল বৃহৎ এবং গভীর! এর প্রতিটা শব্দে লেখকের অন্তরাত্মার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। শাঁওলী মিত্র নিজেই ভূমিকাতে সেসব কথা বলেছেন। ‘অবাল্য যে নাট্যচর্চা ও জীবনদর্শনের ভাবনার সম্বন্ধে অনুভব করেছি তাতেই সম্ভবত এই ছটফটানি।’ তার এই ছটফটানির মৃদু শব্দ আমরা বইটি পাঠ করে শুনতে পাই। আর কেনই বা শোনা যাবে না? আমাদের নাক মুখ চোখতো বন্ধ নয়? আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের শিল্প চর্চা এখন প্রায় হুমকির মুখে। একদিনে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অবক্ষয়, অন্যদিকে বাড়ছে অপসংস্কৃতির নির্লজ্জ চর্চা। লতার মত লকলক করে বেড়ে উঠছে অপসংস্কৃতির নানারকম আগাছার দল।

এখন এই ডিজিটাল দুনিয়ায় আমরা জানি না কোনটা আমাদের জন্য ‘প্রয়োজনীয়’ আর কোনটা ‘অপ্রয়োজনীয়’। আমরা এখন বুঝতে পারি না কিসে আমাদের মঙ্গল আর কিসে আমাদের ক্ষতি! বিশ্বের এই ক্রান্তিকালের বাসিন্দা এখন আমরা। তাই তো মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীর দ্বারে দণ্ডায়মান। নানান প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আমাদের জীবনযাত্রা গেছে বদলে।’

‘ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি’ বইয়ের মোট ৭টি প্রবন্ধই সমাজ এবং সংস্কৃতির অবক্ষয়গুলোকে ঘিরে। তার প্রবন্ধ পাঠে একদিকে যেমন জানা যাবে- বর্তমান সময়ে নতুন প্রজন্মের মনের কথা, পাশাপাশি চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি ক্ষয়ে যাওয়া সংস্কৃতির চিত্রপট।

বইটির প্রথম প্রবন্ধে ‘শতাব্দী শেষে’ প্রশ্ন রেখেছেন তিনি, “সমাজটাতে ‘স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, মিথ্যাচার, এবং তৎসহ কাপুরুষতা এত বেশি পরিমাণ বৃদ্ধি পেল কেন? কোন কোন ঘটনা এমন তীব্র নৈতিক পতন ঘটাতে সাহায্য করল?”

জানি, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা নিরন্তর সবাই খুঁজি আর খুঁজে বেড়াই। কিন্তু, এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে সত্যিকার অর্থে কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা নৈতিকতা এবং মানবতার পথ নিয়ে ভাবেন, যারা আদর্শকেই জীবনের অন্যতম অংশ হিসেবে তাদের বুকে ধারণ করেছেন- তারা আজ নিজেরাই খুব ত্রস্ত সময় পার করছেন। তাদের কেউ কেউ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ আবার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে পাহাড়সম অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে ধাক্কা দিয়ে ভাঙার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন।

আমাদের সমাজ নিয়ে সমাজবাদীদের কপালে এখন চিন্তার রেখা স্পষ্ট। এই সমাজ নিয়ে আমরা সবাই খুব ত্রস্ত! কোথাও কোনো আশার আলো নেই, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় অন্ধকার ঠেলে আলো কী আর সত্যি আসবে না? প্রশ্ন জাগে মনে। আমাদের নতুন প্রজন্ম কোন পথে। তাদের আত্মায় আমাদের সংস্কৃতির বীজটি কতদূর পর্যন্ত প্রোথিত? তারা কী আমাদের ভাষাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে? আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতিকে কী সত্যি বেঁচে থাকবে আমাদের প্রজন্মদের আত্মায়? শাঁওলী মিত্র অবশ্য তা মনে করেন না। তার একটি অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘আকাশবাণী আর দূরদর্শনের মাধ্যমে আমাদের তো প্রত্যহ বহুল এবং বহুবিধ বিজ্ঞাপন শুনতেই হয়! তা সেই বিজ্ঞাপনসমূহে যে বাংলা উচ্চারণ হয়– ও কি সত্যিই বাংলা? তার ঝোঁক, স্বরের উত্থান-পতন, লয়-কিছুই কি বাংলা ভাষার মতন? ও কোন সুর?? নিয়ত এরকম অদ্ভুত বাংলা শুনে আগামী প্রজন্মের কথা বলবার ভাষা কী দাঁড়াবে? সেটা কি আদৌ ‘বাংলা’ থাকবে?’

শাঁওলী মিত্রের মতো আমাদেরও মনেও সেই একই প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়। কারণ শাঁওলী মিত্র যে চিত্রটি কলকাতায় দেখতে পেয়েছিলেন সেই একই চিত্রটি আমরা হুবহু দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশ কিংবা বাঙালি অধ্যুষিত যে কোনো শহরতলীতে। বাংলা ভাষার কাঁধে এখন হিন্দি এবং ইংরেজির ভূত ভর করেছে। দেখা যায়, বাঙালি রক্তের শিশুরা যত দ্রুত ইংরেজি বা হিন্দি বলতে পারে সেই মাত্রায় তারা বাংলা বলতে পারে না। বাঙালি সংস্কৃতিতে এখন প্রবেশে করেছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। বাঙালি আর যেন ‘বাঙালি’ থাকছে না। এ যেন নতুন চেহারায় নতুন এক জাতির উদয়! সন্দেহ নেই যে কোনো সচেতন মানুষের ভাবনায় এটি একটি ত্রস্ত সময় আর কী? এটি একটি ভয় আর উৎকণ্ঠার সময়ও। শাঁওলী মিত্র যেমনটা বলেছেন ‘ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি’।

বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হলো ‘ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি’। সম্ভবত এই একটি প্রবন্ধ দিয়েই পুরো বইয়ের নির্যাস তৈরি করা সম্ভব। সম্ভবত এ কারণেই এই প্রবন্ধের নামটি দিয়েই বইয়ের নামকরণ হয়েছে। এই নামকরণটি খুব যথার্থ হয়েছে। এই প্রবন্ধে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমাদের অনুমান বহুবছর আগে থেকে খুব ধীরে, খুব গোপনেই যেন, আমাদের সংস্কৃতির উপর একটা আক্রমণ শুরু হয়েছিল। আমরা, যারা সাধারণ মানুষ তারা হয়ত বুঝতে পারিনি। কিন্তু কেউই কি কিছু বোঝেননি? যাঁদের উপর দায় বোঝবার, যাঁদের উপর সাধারণ মানুষ নির্ভর করেন, সেই বোদ্ধারাও কি কিছু বোঝেননি? এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর নৈঃশব্দ্যের কারণ কি অজ্ঞতা? নাকি স্ব-স্ব-স্বার্থ?”

যে কোনো সংস্কৃতিবান মানুষ এই প্রশ্ন করবেন, আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রশ্নের ভেতরে কত যে বেদনা লুকিয়ে আছি, কত যে গ্লানি আর ব্যর্থতার দায় ছড়িয়ে আছে তা কী আমরা কখনো অনুধাবন করি? বরং আমরা নির্লজ্জের মতোই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজে ত্রস্ত আর ধ্বস্ত সংস্কৃতিকে বুকে আকঁড়ে ধরে বেঁচে থাকি। কেউ কেউ বলেন, ‘আমাদের হাত বাঁধা, পা বাঁধা’। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমরাও কী এই ত্রস্ত সময় থেকে বের হওয়ার সামান্য চেষ্টা করছিলাম? যারা প্রতিনিয়ত সমাজের নানা রকম অনাচারের নীল নকশা তৈরি করতে ব্যস্ত- তাদের প্রতিরোধের প্রকাশ আমরা কতটা করি বা করতে পারি?

শাঁওলী মিত্র নেই। কিন্তু, তিনি বেঁচে থাকবেন তার কাজে, তার সৃষ্টিতে। কিন্তু, তিনি আরও শক্তপোক্ত হয়ে, আরও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকবেন যদি আমরা তার প্রশ্নগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, বিচার বিশ্লেষণ করি এবং আমাদের হারিয়ে যাওয়া হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনি।

Leave a Reply