You are currently viewing

শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারিতা
লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

গ্রন্থ আলোচনা আদনান সৈয়দ

‘শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারিতা।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বভারতীর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে শিল্পী রামকিঙ্করের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শিল্পীর সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা থেকেই এই গ্রন্থের জন্ম। সন্দেহ নেই ‘শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারিতা’ গ্রন্থের প্রতিটা পাতায় শিল্পী রামকিঙ্করকে আবিস্কার করার প্রাণান্ত চেষ্টা গ্রন্থটি অতিমাত্রায় পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য এবং গ্রহনযোগ্য করে তুলেছে।

গ্রন্থটির ভেতর প্রবেশের পূর্বে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ এর উপর একটু জানা প্রয়োজন। শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজকে বলা হয় আধুনিক ভারতের ভাস্কর্য নির্মাতাদের একজন। প্রকৃতগত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সেটি তাঁর শিল্পের আঁচরে তুলে এনেছিলেন। ভাস্কর্য গড়নের মধ্য দিয়ে বিমূর্ত ছবি নির্মাণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আধুনিক পশ্চিমের চারুকলা এবং ধ্রুপদি ভারতীয় চারুকলার অনন্য মিশেল ছিল তাঁর চিত্রশিল্পের মূল বিষয়বস্তু। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, রবীন্দ্রভারতী কর্তৃক ডি. লিট ও ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘পদ্মভূষণ’লাভ করেছেন।

বিশ্বশিল্পের নানা রং প্রতিনিয়ত তাঁর শিল্প চেতনায় প্রতিফালিত হয়েছে। কবি গুরুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা প্রান্তরের নানা জায়গায় শিল্পী রামকিঙ্করের কাজের দেখা মিলবে। তাঁর আঁকা ছবি আর ভাস্কর্য মানেই যেন প্রকৃতি এবং শিল্পের এক আত্বিক প্রকাশ। বলার অপেক্ষা রাখে না শিল্পী রামিকিঙ্কর ভাস্কর্য শিল্পে শান্তিনিকেতনতো বটেই গোটা ভারতের অন্যতম পুরোধা। শান্তিনিকেতনের জীবন ছিল তার বৈচিত্রে ভরপুর। কখনো তিনি ছন্নছাড়া আবার কখনো সব কিছু ছেড়েটেরে দিয়ে নিজ কাজের এক ধ্যানি করিগর। তখন তাঁকে দেখে চেনা যায় না। মনে হয় তিনি বুঝি সম্পূর্ণ ভীন গ্রহের এক অচেনা বাসিন্দা!

রামকিঙ্কর জন্ম বাকুরায় ১৯০৬ সালে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি আঁকিয়ে। কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। ‘প্রবাসী’ এবং ‘মডার্ণ রিভিউ’ এর সম্পাদক সাহিত্যিক রামানন্দ চট্টপাধ্যায়ের প্রথম এই প্রতিভাকে আবিস্কার করেছিলেন বাকুরায় এবং শান্তিনিকেতনের তৎকালীন শিক্ষক নন্দনাল বসুর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিনে। সেটা ছিল ১৯২৫ সালের কথা। রামকিঙ্করের নিজের ভাষায় সেই স্মৃতি তুলে ধরেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে নন্দনাল বসু তখন কলা ভবনের শিক্ষক রুপে ছিলেন। রামানন্দ বাবু আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন। নন্দনাল বাবু আমার ছবি দেখে বলেছিলেন এতো হয়ে গেছে আর কেন? তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলেছিলেন আচ্ছা ২/৩ বছর থাক ত? আমার সেই ২/৩ বছর আজও আর শেষ হলো না।’

১৫৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি হাতে নিলে শেষ না করে আর উঠা যায় না। গ্রন্থটির নাম দেখে অনেকেই হয়তো অনুমান করবেন যে গ্রন্থটি বুঝি শুধু শিল্পীর সঙ্গে চারুকলা নিয়ে গুরু গম্ভীর কঠিন কথাবার্তা। কিন্তু গ্রন্থটির ভেতরে প্রবেশ করলে এই ভুল ধারণা আপনার ভাঙবে। একজন শিল্পী রামকিঙ্করের পাশাপাশি সেখানে আপনি খুঁজে পাবেন একজন মানুষ রামকিঙ্করকে। লেখক তাঁর বইটির ভুমিকাতেও সে কথা উল্লেখ করেছেন। ‘এই গ্রন্থে শিল্পী রামকিঙ্ককের সঙ্গে মানুষ রামকিঙ্করকেও খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি যায় তবেই আমি ধন্য।’

লেখক সোমেন্দ্রনাথ বোন্দ্যাপাধ্যায় তাঁর কথা রেখেছেন। একজন শিল্পীকে তিনি এই গ্রন্থে নিখুঁতভাবে নির্মাণ করেছেন। এই নির্মাণে রামকিঙ্কর বেইজ কখনো ছিলেন শিল্পী, কখনো ছিলেন আড্ডাবাজ মানুষ আবার কখনো তিনি ধ্যনমগ্ন এক অচেনা দ্বীপের বাসিন্দা। আমরা জানি একজন প্রকৃত শিল্পীর আত্মপ্রকাশ পায় তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। কেউ কেউ এই বিরল প্রতিভা নিয়েই এই পৃথিবীতে জন্মান। রামকিঙ্কর বেইজ এর ব্যাতিক্রম নন। রামকিঙ্কর তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে বলেন,
‘তখন আমি পাঁচ বছরে পড়েছি। বড় দাদা রামপদ মেঝেতে হাতের লেখা শেখাচ্ছেন। শেখাচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখ দুটো আটকে আছে দেয়ালে-টাঙানো রাধাকৃষ্ণের পটে। কানে হাত পড়তেই অগত্যা চোখ নামাতে হয়। তখন থেকেই ছবি আমার চোখ টেনেছে।’

গ্রন্থটির আরেকটি ভালো দিক হল রামকিঙ্করের জীবনের নানা রকম ঘটনাকে সময়ের হিসাবে ভাগ করে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সে কারণেই হয়তো গ্রন্থের প্রথম ভাগেই আমরা শিল্পী রামকিঙ্করকে তাঁর অস্থিমজ্জায় সামনাসামনি দেখতে পাই। বেটেখাট আর মজবুত গড়নের মানুষ। বেশ কাটা কাটা চেহারা। চেহারা দেখে মনে হয় তিনি নিজেই যেন পাথরে খোদাই করা কোন প্রাচীন ভাস্কর্য। বাকুড়ার গাছপালা, নদী, সাওতাল পল্লী, ঝোপ ঝাড়, ঘন জঙ্গল, লাল মাটি এসব প্রকৃতির নির্যাস নিয়ে বেড়ে উঠেছেন এই শিল্পী। গ্রন্থটির পাতা যতই উল্টাই ধীরে ধীরে যেন আরেক অন্যরকম রামকিঙ্কর আবিস্কৃত হতে থাকে। রামকিঙ্কর যখন শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে এলেন তখন শুরু হয় তাঁর আরেক নতুন জীবন! তাঁকে কাজে উৎসাহিত করলেন শিল্পী নন্দনাল বসু এবং স্বয়ং কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? রামকিঙ্কর এর উত্তর,

‘আশেপাশের এইসব, মাঠঘাট, গাঁয়ের মানুষ, সাঁওতাল এদের প্রতিদিনের জীবন- এসব থেকেই। কী কান্ডকারখানা চলছে সারা বছর জুড়ে বরো দেখি। চোখ কান খুলে রাখ-আর দেখো-দু’চোখ ভরে দেখো-নাও কত নেবে। একজন আর্টিষ্ট তার জীবনে কতটুকুই বা নিতে পারে।’

কবি গুরু শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজকে এবং তাঁর কাজকে খুব ভালোবাসতেন। বিশ্বভারতীর খোলা প্রান্তরকে আঙুল উচিয়ে একবার রামকিঙ্করকে বলেছিলেন ‘যেখানে খুশি ভাস্কর্য বানাও’। শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামকিঙ্করও কবি গুরুর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সব মেধা সেখানে ঢেলে দিয়েছিলেন। তাঁর অন্তরাত্মায় যে শিল্পী সত্তাটি ঘাপটি মেরে বসেছিল শান্তিনিকেতনে এসে সেই শিল্পী সত্তাটি যেন ¯্রােতস্বিনী নদীর মত বয়ে চলল। তাঁর খুব সখ ছিল শান্তিনিকেতনে কবিগুরু আর গান্ধীর একটি ভাস্কর্য তৈরি করতে। কাজ অনেকদুর এগিয়েও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল শেষ দিকে এসে আশ্রম সচিব সুরেন কর জানালেন অর্থ নেই। রামকিঙ্করকে সেই উদ্যোগটি আর আলোর মুখ দেখলো না। তার ইচ্ছা ছিল খুব বড় করে ‘স্ট্যান্ডিং ফিগার’ এর দুটো ভাস্কর্য তিনি করবেন। অবশ্য সেই সখ তার পূর্ণ হয়েছিল যখন তিনি সাঁওতাল পরিবার নিয়ে কাজে হাত দিলেন তখন। গুরুদেব সবসময়ই শিল্পী রামকিঙ্করকে কাজে উৎসাহ দিতেন। কবি গুরু চাইতেন তাঁর শান্তিনিকেতনে যে কাজ গুলো হয় তা যেন ইউরোপ আমেরিকার মত বড় বড় দেশের সঙ্গে তুলনীয় হয়। রামকিঙ্করকেও তিনি বলতেন বড় ফিগারের কাজ করতে। ‘দেখিসনা য়ুরোপে কেমন বড় কাজ করে, বেশ জোর প্রকাশ পায় তাতে’
বড় ফিগারের কাজের প্রতি কবি গুরুর বিশেষ অনুরাগ ছিল। রামকিঙ্কর কবি গুরুর কথা রেখেছিলেন।

এই গ্রন্থটির আরেকটি ভালো লাগার বিষয় হল রামকিঙ্করের চরিত্রটির সাবলিল রূপায়ন। রামকিঙ্কর প্রকৃতিতে যেমন ছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে যেন বইয়ের পাতায় অপরিসীম দক্ষতায় বন্দি করা হয়েছে। এই জন্যে বইটি আরো বেশি সুখপাঠ্য হতে বাধ্য। একজন শিল্পীর বহুমুখি চরিত্র তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। শিল্পীদের এই পাগলামোর নানান খবর আমরা কম বেশি জানি। রামকিঙ্করও এর উর্ধ্বে নন। বইটিতে ঠিক এমন একটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। একটি ছবি এক্সিবিশনে রামকিঙ্কর হলেন প্রধান অতিথি। তাঁকে দিয়েই ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু রামকিঙ্কর ফিতা কাটতে রাজি নন। তারপর উদ্যেক্তরা বললেন তাহলে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধন কার হোক। কিন্তু তাতেও রামকিঙ্কর নিজের কানে ধরে বললেন পারবেন না। শেষ পর্যন্ত রামকিঙ্কর নিজের একটা পথ বাতলে দিলেন। ছবি আঁকতে আঁকতেই তিনি অনুষ্ঠান উদ্ববোধন করবেন। বিষয়টার নতুনত্বে সবাই খুব খুশি হল। কিন্তু ঘটনা ঘটলো এর কিছুক্ষণ পরেই। রামকিঙ্কর আপন মনে ছবি আঁকছেন। এমন সময় রাজ্য মন্ত্রী অনুষ্ঠানে এস হাজির। আয়োজকরা রামকিঙ্করকে ডাকছেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য স্বাক্ষাতের জন্যে । কিন্তু রামকিঙ্কর তাঁর ছবি আঁকায় মগ্ন। শেষপর্যন্ত তাঁকে একরকম জোড় করে মন্ত্রীর সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। রামকিঙ্কর মন্ত্রী দেখে চিৎকার করে বললেন, ‘না না ,এঁকে আমি বর্ধমানে দেখেছি-বর্ধমানে দেখেছি।’

শিল্পী রামকিঙ্কর একজন বড় মাপের শিল্পী শুধু নন তিনি বড় মাপের একজন মানুষও। তাঁর মনটা যেমন মাটির মত তেমন হৃদয়টাও আকাশের মত উদার। শহরের রঙচং মাখা আধুনিক কেতা তিনি কখনই রপ্ত করতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, ‘আমিও ওদের স্বজাত- ওঁরাও, সাওতাল, চাষী মুটে মজুর। ওদের ভাষাটা আমি বুঝি। দেখো, ভদ্রলোকদের অনেক সময় ঠিক বুঝি না। বুঝতে পারিও না। ওখানে সুর বড় কম।’

লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মহৎ কাজটি করে আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছেন । গ্রন্থটিতে রয়েছে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের আঁকা রঙিন একটি ছবির এলব্যাম যা হতে পারে রামকিঙ্কর ভক্তদের এক বাড়তি পাওনা।

গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিল্পী রামকিঙ্ককের সতীর্থ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে।

শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারিতা
লেখক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

Leave a Reply