You are currently viewing আট দশক

আট দশক

আট দশক

ভবতোষ দত্ত

প্রকাশকঃ প্রতীক্ষণ পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড

কলকাতা।

পাঠ প্রতিক্রিয়া আদনান সৈয়দ

 স্মৃতিকথা আমার ব্যাক্তিগতভাবে খুবই প্রিয়। একজন লেখককে তাঁর স্মৃতিকথা অথবা ব্যাক্তিগত জার্নাল পাঠে অস্থিমজ্জায় যেন ছুঁয়ে দিতে পারি।  শুধু তাই নয় স্মৃতিচারণের আয়না ধরা পরে একটি কাল, রাজনীতি, সমাজের বাঁকে বাঁকে জমে থাকা বিচিত্রসব আখ্যান। লেখক ভবতোষ দত্ত পেশায়  অর্থনীতিবিদ। তবে বাংলা ভাষার লেখক হিশেবে তাঁর আলাদা একটা বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে। তাঁর স্মৃতি কথা ‘আট দশক’ গ্রন্থটি আমাদের কাছে  নান কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত তার এই গ্রন্থে সেই পুরনো ঢাকার নানা রকম মজার মজার গল্প, দেশ ভাগ, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, রাজনীতি,  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকায় আগমন আর সবেচেয়ে বড় কথা সেই ত্রিশ দশকের ঢাকার নানান ঘটনা নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গ্রন্থটি পাঠ করার পর মনে হবে এটি বুঝি আমাদের বাঙালির রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের  অনন্য দলিল। ভবতোষ দত্ত ১৯২২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তার এক বছরের উপরের ক্লসে ছিলেন বুদ্ধদেব দেব বসু। তাদের বাসা ছিল ঢাকার ওয়ারিতে। গ্রন্থটির ‘বুড়িগঙ্গা’য় অধ্যায়ে তিনি লিখলেন, “ ওয়ারি ঠিক শহরতলি নয়, কিন্তু শহরের মধ্যে হয়েও একটু ভিন্নরকমের- উপান্তিক না হলেও প্রান্তিক। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, রাস্তার লোক বেশি নেই, যারা আছে তারাও পোশাকে-পরিচ্ছদে মার্জিত। বাড়িগুলি সুন্দর- একতলাই বেশি, কয়েকটি মাত্র দোতলা- আর প্রত্যেক বাড়িতে অনেকটা খোলা জমি। রাস্তাগুলি একটি আর-একটির সঙ্গে সমান্তরাল, না হয় সমকোণ। এখানে রমনা-র অভারতীয় উদ্যান-নগরীর স্বাচ্ছন্দ্য নেই, পুরানো পল্টনের নবীনতা নেই, টিকাটুলীর গাম-ছোঁওয়া অভাব নেই, নবাবপুরের ঘিঞ্জি বসতিও নেই। সবই একটু সংযত, সবই বাহুল্য বিহীন।”

পুরনো ঢাকার এমন বর্ণনা আর কোথায় পাওয়া যাবে? তাঁর আরেকটি বর্ণনায় তৎকালীন ঢাকার রাস্তার ফেরিওয়ালার ডাক আর সেই সঙ্গে ছোট বাচ্চাদের জন্যে বিভিন্নরকম মাজাদার খাবার দাবারের বর্ণনা দেখতে পাই। ‘রাস্তা দিয়ে সকালে বিকেলে ডাক দিয়ে যায় “বাখরখানী”- প্রকান্ড সাইজের স্বদেশী ক্রিমক্র্যাকার। ধামাতে থাকে আরো নানা রকমের ‘হিন্দু” বিস্কুট-যার কোনোটার নাম “তক্তি”, কোনোটার নাম “ নারকোলি”- আর যার কোনোটারই দাম এক পয়সার বেশি নয়। বিকেলের দিকে আসে চীনেবাদামওয়ালা, এক পয়সায় এক রাশি বাদাম দিয়ে যায়। আর আসে ছোট ছোট ঠোঙা ভরতি চানাচুর নিয়ে দু-একটি লোক-হেঁকে যায় “কুড়মুড়, কুড়মুড়, চারভাজা, খেতে লাগে বড়ই মজা।’

আগেই উল্লেখ করেছি  গ্রন্থটির পাতায় পাতায় রযেছে লেখকের অসাধারণ সব স্মৃতি আর সেই সঙ্গে তার সরস বর্ণনা। ১৯২৬ সালে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন এবং সেই নিয়ে রয়েছে তাঁর এক অসাধারণ স্মৃতি।

১৯৪৩ সালে ভবতোষ দত্ত কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি লিখছেন ‘ছাত্ররা আমাদের অত্যন্ত সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আমরা মুসলমান নই বলে যেন কোনো আঘাত না পাই তারও চেষ্টা করতেন। প্রায় সব ছাত্রই অবশ্য লীগপন্থী। পাকিস্তানকামী। মুসলমান শিক্ষকরাও তাই। তবে কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনে দুটো দল হতো- একটা বাংলাভাষীর দল আর অন্যটা উর্দুভাষীর দল। উর্দুভাষীরা নিজেদের একটু বেশি কুলীন মনে করতেন। কিন্তু বাংলাভাষীদের সংখ্যা ছিল বেশি। এই বাংলাভাষী দলের নেতা ছিল একটি কৃশকায় ছেলে- নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তার নীতি শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতই ছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে সফল হয়েছিলেন। ইসলামিয়ার ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬-এর রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত। ওল্ড বালিগঞ্জের কাছে অপেক্ষা করত আর সেখান থেকে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে কলেজে নিয়ে যেত। আবার সেভাবেই ফিরিয়ে দিয়ে যেত।

সব মিলিয়ে ভবতোষ দত্তের ‘আট দশক’  অনন্য একটি গ্রন্থ। যারা পুরনো স্মৃতি এবং ইতিহাসকে আবারো নতুন করে ঝালাই করে নিতে চান তাদের জন্যে ‘আট দশক’ বিশেষ খোরাক হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।

Leave a Reply