You are currently viewing উপন্যাসঃ পরম সুন্দরী

উপন্যাসঃ পরম সুন্দরী

লেখক মনিজা রহমান

প্রকাশকঃ অন্যপ্রকাশ

প্রকাশকালঃ ২০২৩

পাঠ প্রতিক্রিয়া আদনান সৈয়দ

আমি নিজেও যেহেতু প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময় ধরে প্রবাস জীবনে গা ভাসিয়েছি তাই আমি জানি নিজ দেশ আর সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এই অভিবাসী জীবনের মালা গলায় ধারণ করা কত যন্ত্রনার আর কত কঠিন! তারপরেও মানুষ স্বপ্নতাড়িত প্রানী। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ভাষায়, ‘ মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। সত্যিই তাই। এই স্বপ্নকে বুকে নিয়ে মানুষ পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে বেড়ায়।  এই দেশান্তরিত হওয়ার প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত। কিন্তু কথা হলো যে আশা, আকাংখা, স্বপ্নকে বুকে নিয়ে মানুষ তার নিজের দেশ আর সংস্কৃতি ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবনের ঠিকানায় আছড়ে পরে সেই নতুন জীবনকে সে বাস্তবে কত্টুকুই খুঁজে পায়? কারণ অভিবাসী জীবন মানেই সংগ্রামী জীবন। যুদ্ধের জীবন। এই জীবনে টিকে থাকতে তাদের ‍যুদ্ধ করতে হয়। এবং যুদ্ধে তারা জয়ীও হয়। এ কারণেই তাদের ‘পরম সুন্দরী’ আখ্যাও দেয়া যায়।

সম্প্রতি হাতে পেয়েছি লেখক মনিজা রহমানের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘পরম সুন্দরী’। মনিজা রহমানের লেখার সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত্। জানা আছে তিনি কবিতা লিখেন, গল্প লিখেন, অনুবাদও করেন। তবে এই প্রথম তাঁর উপন্যাস পড়ার সুযোগ হলো। উপন্যাসটি সাজানো হয়েছে চারজন অভিবাসীর জীবনের গল্প দিয়ে। আয়শা, রেবেকা, ফাল্গুনী ও জেসি। তারা সবাই জীবনের প্রয়োজনে নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে থাকেন। সেই সুবাদে তারা পরস্পর বন্ধু। অন্য সব অভিবাসীদের মতই তাদের জীবন। দুঃখ আছে, বেদনা আছে আর আছে বুক ভরা স্বপ্নও। তারপরেও তাদের জীবন একেক জনের একেক রকম। কেউ পারিবারিকভাবে সুখি, কেউ অর্থনৈতিক টানপোড়েনে বন্দি আবার কেউ হয়তো জীবনটাকে ভাসিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রের মুক্ত শিকারীর মতই। তাঁর উপন্যাসের বড় শক্তি মনে হয়েছে তিনি প্রতিটি চরিত্রগুলোকে সঠিকভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। আগেই বলেছি, আমি নিজে যেহেতু এই প্রবাস জীবনের সঙ্গে যুক্ত তাই এই উপন্যাসের অনেক ঘটনা আমি যেন চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছিলাম। কখনো কখনো মনে হয়েছে অনেক ঘটনার আমি নিজেই যেন সাক্ষী। যেমন প্রবাস জীবনে রুম শেয়ার করার বেদনা যে কত সেটি একজন অভিবাসী হারে হারে জানেন। আর সেই রুমমেট যদি একজন নারী হোন তাহলেতো কথাই নেই। কেউ যখন এই অভিবাসী জীবনকে বেছে নেন তখন শুরু দিকে তাকে রীতিমত যুদ্ধে নামতে হয়। এই যুদ্ধ নিজেকে টিকে থাকার যুদ্ধ আবার যুদ্ধটা করতে হয় ভীনদেশি সংস্কৃতির সাথেও। একদিকে দেশ থেকে বয়ে নিয়ে আসা নিজের সংস্কৃতি, আচার এবং বিশ্বাস অন্যদিকে ভীনদেশি আলো হাওয়ায় নিজেকে তৈরি করে নিতে নিত্যনতুন ত্যাগ। চার বন্ধু আয়শা, রেবেকা, ফাল্গুনী এবং জেসি এই চারটি চরিত্রের সঙ্গে এই কথাগুলোর সাযুজ্য আছে বলে আমি মনে করি।

উপন্যাসটির একটি আলাদা বৈশিষ্ঠ্য চোখে পড়েছে। চার বন্ধু আলাদা আলাদা ভাবেই নিজেদের গল্পটি বলছেন। আবার চারজনের গল্পগুলো একত্রে মালা গাঁথলে উপন্যাসের মূল সুরটিও পাঠকের সামনে ধরা দিচ্ছে। মনে পড়ছে প্রমথ চৌধুরীর ‘চার ইয়ারির কথা’ উপন্যাসটির কথা অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’র কথাও। ’চার ইয়ারির কথা’ উপন্যাসে চার বন্ধু সোমনাথ, সিতেশ, রায়(যিনি গল্পটি বলছেন) এবং সেন। এক ঝড়ের রাতে এই চার বন্ধু তাস খেলায় মগ্ন ছিলেন । কিন্তু বাইরে ছিল প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি। এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের নিজেদের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন তারা সবাই নিজেদের গল্প বলে রাত পার করে দিবেন। শুরু হয় গল্প। জীবনের কত রকম না বলা গল্প। সেই গল্প কিছু কল্পনার আর কিছু বাস্তবের। ধিরে ধিরে চার বন্ধুর গল্পগুলো মিলে হয়ে উঠে আরেকটি গল্প। এ যেনো গল্পের ভেতরে আরেক গল্প ঘুমিয়ে আছে। লেখক মনিজা রহমানের উপন্যাসটিও গল্পের মধ্যে আরেক গল্প ধরা পরেছে। চার বন্ধুর জীবনের গল্পের স্রোতে ভাসত ভাসতে পাঠক যেন অভিবাসী জীবনের আরেক নতুন গল্পকে খুঁজে পাবেন। পাঠক দেখতে  পাবেন এই সংগ্রামী লড়াকুরাও তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিতে পারেন। এই সংগ্রামী যোদ্ধারা তারা নিজেদের জায়গা থেকে সবাই স্বার্থক, সুন্দর।

‘পরম সুন্দরী’ উপন্যাসটির আরেকটি বিষয় হলো চরিত্রের যথাযথ রূপায়ন। তিনি খুব সতর্কতার সাথেই চার বন্ধুর চার রকম চরিত্রকে আলাদা করে রূপায়ন ঘটিয়েছেন। চার জনের জীবন ভিন্ন, আবার কোন কোন জায়গায় এই চারজন যেন একই সুতায় গাঁথা। এই বিষয়টিকে তিনি খুব সুন্দর আর মুন্সিয়ানার সাথেই তাঁর উপন্যাসে তুলে এনেছেন। তবে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তিনি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষন করতে পারতেন। শুধু চরিত্র কেন, অভিবাসী সমাজের নানান টানপোড়েনকে তিনি বেশি বেশি ডায়লগের আশ্রয় না নিয়ে সেখানে ঘটনা ন্যারেটিভ ফর্মে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। মনে পড়ছে অ্যামি টান এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ দি জয় লাক ক্লাব(The Joy Luck club) এর কথাই ধরা যাক। চার চাইনিজি আমেরিকান অভিবাসীর জীবনের নানান গল্প নিয়ে এই ‍উপন্যাস। উপন্যাসটি শুধুই চার বন্ধুর  গল্প নয় বরং সেখানে উঠে এসেছে ভীনদেশি সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। উপন্যাসটি আমেরিকার সাহিত্য পাড়ায় বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক পুরস্কার, নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলারসহ অনেক অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল উপন্যাসটি। মনিজা রহমানের এই উপন্যাসটিও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হলে পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্য সমাজে বিশেষ কদর পাবে বলে আমি মনে করি।

সবশেষে আরেকটি কথা। মনিজা রহমান খুব অল্প সময় নিউ ইয়র্কে থেকেও দীর্ঘ  প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা বুকে ধারণ করে এই উপন্যাসটি লিখতে পেরেছেন। এটি আমার কাছে বিস্ময়! এখানেই লেখকের শক্তি। তাঁর এই কাজ বেঁচে থাকবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। তাঁকে আমার টুপি খোলা অভিনন্দন।

উপন্যাসটি নান্দনিক প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। বইটি পাওয়া যাবে অন্যপ্রকাশের বইয়ের দোকানে। আর অনলাইনে রকমারি ডটকমসহ অন্যান্য অনলাইন বই বিক্রেতাতো আছেই।

গ্রন্থটির সাফল্য কামনা করছি।

হেপি রিডিং..

Leave a Reply