কথায় কথায় রাত হয়ে যায়
লেখক পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
কথায় কথায় রাত হয়ে যায়
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক মুক্তধারা বইয়ের দোকান থেকে খরিদ করেছি বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিকথা ‘ কথায় কথায় রাত হয়ে যায়।’ প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স। সেই বইটি খুব ধীরস্থিরভাবে সময় নিয়ে পড়ছি। কারণ আপনারা হয়তো জানেন কিছু কিছু বই পড়তে হয় ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে, রস নিংড়ে নিংড়ে। আহা! বইটির বাদামি পাতায় যখনই চোখদুটো ডুবাই তখনই প্রাণটা যেনো হারিয়ে ফেলি সেই পঞ্চাশ আর ষাট দশকে শিল্পঘেরা সময়ের এক গহীন অরণ্যে! তখন বাংলা শিল্প সংস্কৃতি পাড়াটি বেশ জমজমাট হয়ে জমে উঠেছিলো। একদিকে রয়েছেন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মত মানুষ! তাঁরা প্রানের সুখে গান লিখছেন আর অন্যদিকে মান্নাদে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, কিশোর কুমার, আরতি মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলেসহ বিখ্যাত গায়ক/গায়কিরা সেই গান তাদের কন্ঠে তুলে নিচ্ছেন!
কী অসাধারণ সেই গানের কথা, সুর আর অর্কেস্ট্রার আয়োজন! ভাবাই যায় না আজ থেকে ৭০/৮০ বছর আগে এই কালজয়ি শিল্পগুলোর জন্ম হয়েছিলো! আজ এত বছর পরও আমরা সেই সৃষ্টিশীলতায় সময় পেলেই ডুব দেই, এখনোও ভালো একটি গান, ভালো একটি বই অথবা ভালো একটি চলচ্চিত্রের সন্ধান পেলে আমরা পায়ে রক্ত ঝড়িয়ে শত শত মাইল হাটতে শুরু করি!
আমাদের এমন কেউ কি আছেন যিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গান শুনেননি? এমন কেউ কি আছেন যিনি সেই গান শুনে নিজেই অতি ভালোবাসায় গুনগুন করে সেই গানটি নিজের কন্ঠে তুলেন নেননি? আমাদের শৈশব থেকে এই পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে তাঁর এই অনবদ্য সৃষ্টিগুলো জড়িয়ে আছে। আর সেই গান যদি হয় ‘ আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো’, ‘ নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, আমার বলার কিছু ছিলো না’, রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে?’, এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনার’, ‘ এইতো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’, ‘ আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হয়েই বেশ ছিলাম’ ইত্যাদি। এই কালজয়ি গানগুলোর স্রষ্ট্রা গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থ ‘ কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’। যতই পড়ি ততই যেন গ্রন্থের পাতায় বেজে উঠে একটি সময়ের ইতিহাস, একটি শিল্প গড়ার পেছনের গল্প। সেই গল্পগুলো কখনোর বেদনার মত বেজেছে, কখনো ভালোবাসায় অনেক যত্নে মোড়ানো আবার কখনো রক্তাত্ব পথ পাড়ি দিয়েছে। সত্যি তাই! একটি মহৎ শিল্প একদিনেই গড়ে উঠে না! এটি একটি যুদ্ধ! প্রতিনিয়ত সেই যুদ্ধে একজন শিল্পী কতভাবেই না রক্তাত্ব হোন! তারপর আসে সফলতা। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ব্যতিক্রম নন নিশ্চয়ই!
এই গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহজ সরল আর বৈঠকি আড্ডার মেজাজ মিশিয়ে নানা রকম অজানা তথ্য পরিবেশনা। কত কত অজানা সেই গল্প! সেসব ঘটনা পড়ি আর নিজেই শিহরিত হই!
ইনস্ট্যান্ট গান লেখায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার। হোটেলের লবিতে , স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দেখতে, স্টুডিওতে বসে কোন শিল্পীর গান শুনতে শুনতে, কোনো শিল্পীর বাড়িতে বৈঠকখানায় বসে আড্ডা দিতে দিতে এমনকি বিমানবালার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও তিনি গীত রচনা করেছেন। একবার বিমানভ্রমণের সময় সেখানে এক বিমানবালাকে দেখে তিনি লিখলেন, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’।
একদিন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দেখতেই তিনি রচনা করলেন, ,‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’। আরেকদিন রেস্তোরাঁর বসে ন্যাপকিনে লিখেছিলেন, ‘রঙ্গিলা পাখিরে কে ডাকে ঘুম ঘুমৃ। একবার এক অনুষ্ঠানে এক নারীর কান থেকে ঝুমকো খসে পড়ে গেল। সেই ঝুমকো কুড়িয়ে তিনি লিখলেন, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি ঝরে পড়েছে’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত একজন মহৎ শিল্পীর পক্ষেই সেটি সম্ভব।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,
’একজন যায় আর একজন আসে। এই হয়তো পৃথিবীর নিয়ম। তবু একজন চলে না গেলে একজন যে আসতে পারতেন না, তার প্রমাণ তিন—তিনবার পাওয়া গিয়েছে সংগীত জগতে। গীতা দত্ত চলে যেতেই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠলেন আশা ভোঁসলে, তার আগে নয়। কিশোরকুমার চলে যেতেই মানুষ চিনল কুমার শানুকে, তার আগে নয়। আর মহম্মদ রফি চলে যেতে যেতেই মানুষ জানল মহম্মদ আজিজকে(মুন্না), তার আগে নয়।’
হায়! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে একজন পুলক চলে গেলেন কিন্তু তাঁর স্থান পুরণ করার মত কিন্তু নতুন কেউ কিন্তু আর আসেননি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত একজন বড় গীতিকার এই বাংলায় আবার জন্ম হবে কিনা সন্দেহ! এটাই সত্য কথা।
‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ গ্রন্থটি নিতান্তই একটি স্মৃতিগ্রন্থ নয়। এটি একটি সময়কে বন্দী করে লেখা প্রামান্য দলিলও। এই গ্রন্থের স্বাদ না নিয়ে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিলে আপনাকে যে পস্তাতে হবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত!