You are currently viewing কাব্যগ্রন্থঃ কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা

কাব্যগ্রন্থঃ কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা

কাব্যগ্রন্থঃ কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা

অনুবাদঃ অনন্ত উজ্জ্বল
প্রকাশকঃ স্বদেশ শৈলী
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ সোহেল আশরাফ

গ্রন্থ আলোচনা করেছেন আদনান সৈয়দ

সম্প্রতি হাতে এসেছে কবি, অনুবাদক, প্রকাশক এবং সংগঠক অনন্ত উজ্জ্বলের অনূদিত ‘কানাডিয়ান কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা’। মোট ১৬টি কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ। খুব ঝরঝরে ভাষায় অনূদিত প্রতিটা কবিতাই সুখপাঠ্য। এর জন্য অনন্ত উজ্জ্বল বিশেষ ধন্যবাদ অবশ্যই পেতে পারেন। প্রকাশক করেছে স্বদেশ শৈলী। অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী সোহেল আশরাফ। গ্রন্থটির মূল্য ২৫০ টাকা।

প্রথমেই কবি মার্গারেট অ্যাটউড নিয়ে দুটো কথা বলতে চাই। এ কথা আমরা বিশ্বাস করি যে সব লেখকেই শিল্প নির্মাণে একটি নিজস্ব ফিলোসফি আছে। মার্গারেট অ্যাটউড এই নিজস্ব ফিলোসফি ভাবনার ব্যতিক্রম কেউ নন। শিল্প সাহিত্যে নৈতিকতার প্রশ্নে তাঁর অবস্থান তিনি স্পষ্ট করেছেন। অ্যাটউডের কবিতা পড়লে পাঠক সেই নির্মাণকে সহজেই দেখতে পাবেন।
অ্যাটউড শিল্পসাহিত্যের শুধুমাত্র একজন কড়া সমালোচক। পাশাপাশি সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর যুক্ততা রীতিমত বিস্ময় সৃষ্টি করে। সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পাড়ায় তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থক লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। ১৭টি উপন্যাস, ১৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১০টি প্রবন্ধের বই, ৮টি ছোট গল্প, ৮টি শিশুতোষ এবং ৩টি গ্রাফিক উপন্যাস কম কথা নয়! ৮৩ বছর বয়সেও লেখালেখিতে তিনি চলমান। প্রতিদিন কফি মগে চুমুক দিতে দিতে তিনি ফেসবুক এবং টুইটারে তাঁর প্রিয় বই নিয়ে কথা বলেন, আলোচনায় মেতে উঠেন। আবার লেখক সত্তার বাইরেও তাঁর জীবন নয়। জীবনের নানা রকম কাজকর্মে তিনি জড়িয়ে থাকেন ঠিকই তবে লেখালেখিকে তিনি বেছে নিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে।
তাঁর লেখালেখিতে ৩টি বিষয় খুব চোখে পড়ে। ১) তিনি একজন নারীবাদী লেখক, ২) সাহিত্য নির্মাণে তিনি রোমান্টিকতা এবং পৌরনিক সত্তায় আশ্রয় নেন এবং ৩) কানাডার জাতীয়তাবাদী আবেগকে তাঁর লেখায় সবসময় ফুটে উঠেছে। এই তিনটি বিষয়কে বাঁধলে অ্যাটউডকে খুঁজে পাওয়া যাবে। নারীবাদ, নারীর যৌন স্বাধীনতা, লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারী অধিকার তাঁর সাহিত্যে উঠে এসেছে। তিনি নারীর যন্ত্রনাকাতর ছবিটাকে সাহিত্যে এঁকেছেন বাস্তব দুনিয়ার তুলি দিয়ে।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ The Edible Woman(1969)’ এর কথাই ধরা যাক। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কলেজ পড়ুয়া এক নারী যার নাম ম্যারিয়ান ম্যাকআলপাইন। ম্যারিয়ানকে কেন্দ্র দুইজন পুরুষ। একজন তার প্রেমিক পিটার এবং আরেকজন তার শিক্ষক ডানকান। দুজনের সঙ্গেই ভালোবাসার জটিল সম্পর্ক। এই কাহিনীকে ঘিরেই শুরু হয় সামাজিক এবং রাজনৈতিক অন্তর্গত দ্বন্দ্ব।
এবার অনন্ত উজ্জ্বলের অনুবাদে গ্রন্থ ‘কানাডার কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা’ প্রসংগে চলে আসি। আগেই উল্লেখ করেছি তিনি একজন রোমান্টিক কবি আবার নারী অধিকারেও তিনি সমানভাবে সোচ্চার। এই দ্বৈততাকে তিনি কবিতায় একত্র করেছেন। আবার তিনি এই দ্বৈততাকে তিনি বিচ্ছেদ হিসেবেও ব্যাবহার করেছেন। তাঁর কবিতা পাঠ করলে দেখা যায় তিনি কোন কবিতাতেই বিষয় বৈচিত্রে স্থির থাকেননি। কবিতায় দৃশ্যকল্প ব্যবহারে তাঁর মুন্সিয়ানার হাত অনেক। তবে এই দৃশ্যকল্পগুলো আবার কোলাজের মত কবিতায় ফুটে উঠেছে। কবিতায় তীক্ষ্ণ শব্দ ব্যবহার করে তিনি আরো বেশি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পেরেছেন। যেমন একটি উদাহরণ দিই
‘যে গলিত চামচ দিয়ে বাটি ঘষছি
সেই বাটিও গলে যাচ্ছে
তার আশেপাশে কেউ নেই।’( পোড়া বাড়িতে সকাল বেলা)

আগেই উল্লেখ করেছি প্রকৃতি, পরিবেশ সচেতনা এবং জলবায়ু তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয়। কবিতায় তিনি প্রায় সময়ই এই বিষয়গুলোকে তুলে এনেছেন। তাঁর কবিতা খুব বেশি লম্বা নয় কিন্তু শিল্পগুনের দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। খুব ছোট অথচ তীক্ষ্ণ কোন চিত্রকল্প দিয়ে তিনি অনেক কথাই যেন বলে ফেলেন।
‘পাহাড়ের খাদে একটি হরিণের
মৃতদেহ, তার মাথা নেই।
পাখি উড়ে যাচ্ছে পরিচ্ছন্ন আকাশ দিয়ে
হালকা গোলাপী সূর্যালোকের বিপরীতে।(তুমি কি সুখী)

১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর এই মার্গারেট অ্যাটউডের জন্ম। বুঝতে অসুবিধা হয়না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তবে তিনি তাঁর কবিতায় যুদ্ধের বাহ্যিক চিত্র নয় বরং মানুষের প্রতিনিয়ত অন্তর্গত যুদ্ধের চিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বর্তমান পৃথিবীতে এমন একটি সময়কে তুলে এনেছেন যেখানে মানুষের হৃদয় এখন নানাভাবে রক্তাত্ব। মানুষ আর প্রকৃতি দুটোই এখন বিপন্ন। এই বিপন্নতাকে তিনি তাঁর লেখায় শিল্পে রূপ দিয়েছেন। লক্ষ্য করুন,
‘তুমি আমার সঙ্গে মানানসই
ঠিক যেমন চোখের ভেতর বর্শি।(তুমি আমার সঙ্গে মানানসই)’

তার কবিতায় রয়েছে আত্মপরিচয় খোঁজার নিরন্তর চেষ্টা, বারবার পৌরনিকি কাহিনীতে ফিরে যাওয়া আবার কখনো কানাডার স্বদেশীয় সংস্কৃতির মুগ্ধতার গান। তার কবিতায় ফুটে উঠে একজন নারীর মানসিক রাজনৈতিক আশ্রয়। পুরুষ শাষিত এই সমাজের গল্পগুলো তখন রক্তাত্ব হয়ে ফুটে উঠে তাঁর কবিতায়।
‘শিশুর বন্দুকের গুলির সঙ্গে বেঁকে যাচ্ছে
বাইরেরে গাছগুলো। তাদের কথা বাদ দাও।
তারা তো খেলছে তাদের নিজস্ব খেলা(ছায়ার কথা)’

‘আমি একজন রাজনৈতিক সচেতন লেখক হিসেবেও নিজেকে উল্লেখ করতে চাই।’ ভ্যান গেলডারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার বেদনা তার কবিতায় উঠে এসেছে। মৃত্যু, সম্পর্ক, মানুষের নৈতিক এবং মানবিকতাও তাঁর কবিতার বড় অংশ।
নারীবাদ, প্রকৃতিবাদ, পরিবেশ সচেতনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার তার কবিতায় উঠে এসেছে। অ্যাটউড বিশ্বাস করেন একজন লেখককে প্রতিনিয়ত শিল্প-সাহিত্যে তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং নিজের তৈরি জগতে ডুবে থাকতে হয়। জীবন বাস্তবতা তার এক হাতে থাকে আর অন্যহাতে থাকে শিল্প নির্মাণের জগৎ। এই দুটো সত্তাকে তিনি ভেংগেচুরে এক করেছেন। মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে এই সম্পর্ককে তিনি তাঁর কবিতায় অনুসন্ধান করেছেন।
‘আমি বললাম;
আমরা বন্ধু হতে পারি না?
তুমি কোনো উত্তর দিলে না( সে বারবার ফিরে আসে)’

অ্যাটউডের কবিতায় আমরা আশার বাণী খুঁজে পাই। চলমান বিক্ষুব্ধ দুনিয়ায় প্যান্ডোরামের বাক্সে বন্দি হয়ে আছে ‘আশা’ নামের লোভনীয় শব্দটি।

যার শুরু আছে, তার শেষও আছে,
তুমি কী করে কীভাবে শুরু এবং শেষ করবে,
তা তোমার হাতে(তোমার শুরু)

মার্গারেটে অ্যাটউডের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করা অনেক পরিশ্রমের কাজ। এই পরিশ্রমলব্ধ কাজটি করার জন্য কবি এবং অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বলকে অভিনন্দন।

Leave a Reply