You are currently viewing গ্রন্থঃ পাখিরোষ (গল্পগ্রন্থ)

গ্রন্থঃ পাখিরোষ (গল্পগ্রন্থ)

লেখকঃ আশরাফ জুয়েল

প্রকাশকঃ ঐতিহ্য

প্রকাশকালঃ ২০২২

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আদনান সৈয়দ

গল্পকার আশরাফ জুয়েলের গল্পের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিলো তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’ এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে দুঃসহ করোনাকালে ঢাকায় যখন বন্দি জীবন যাপন করছিলাম তখন তাঁর সঙ্গে অভিনবভাবেই আমার পরিচয় ঘটে। করোনার বন্দিত্ব থেকে মুক্তির জন্য আমরা কয়েকজন শিল্প-সংস্কৃতিমনা বন্ধু হোয়াটস অ্যাপকে কেন্দ্র করে একটি শিল্প-সাহিত্য গ্রুপ খুলে সেখানে তুমুল আড্ডার আয়োজন করেছিলাম। আশরাফ জুয়েল সেই গ্রুপের সদস্য ছিলেন। সেই গ্রুপে প্রায় সময়ই তিনি তাঁর গল্প পোষ্ট করতেন এবং তখন থেকেই ওঁর গল্পের আরো কাছাকাছির আসার সুযোগ ঘটেছিলো।

তখনই লক্ষ্য করেছিলাম আশরাফ জুয়েলের গল্প পড়তে হলে চোখ টান টান করে রাখতে হয়, মনটাকে রাখতে হয় ধিরস্থির আর যথাসম্ভব সামাজিক এবং পারিবারিক নানা রকম দায় দায়িত্ব থেকে ভারমুক্ত করে। কারণ ওঁর গল্পের প্রতিটা শব্দই পড়তে হয় খুব খুটিয়ে খুটিয়ে। কোন একটা শব্দ অথবা একটা বাক্য  যদি কোন অসাবধনাতার কারণে বাদ পড়ে যায় তখন সেই গল্পটার পুরোপুরি স্বাদ আর থাকে না। আরেকটা কারণ হল ওর গল্পে প্রচুর মেটাফোর/চিত্রকল্পের ব্যাবহার। এসব তাঁর গল্পের অলংকার। এই অলংকারগুলোকে মস্তিস্কে তুলে নিয়ে গল্পের জলে ডুব দিতে পারার আনন্দই আলাদা!

তাঁর গ্রন্থ আলোচনা করার আগে আরেকটি বিষয় পরিস্কার করে নিতে চাই। লেখক আশরাফ জুয়েল মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন কবি। মনে রাখতে হবে কবিসত্তাকে বুকে ধারণ করে তিনি যখন গল্প লিখবেন তখন সেই গল্পের শরীর জুরে ম্যাজিক রিয়েলিজম, মেটাফোর, চিত্রকল্প বাসা বাঁধতে বাধ্য। ওঁর গল্পগুলোর দিকে তাকলে দেখা যায় তিনি নীরিক্ষাধর্মী গল্প লিখতে বেশি উৎসাহী। তাঁর বিশেষ এক ভাষা রীতি আছে। এ ক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিক গল্পকারদের থেকে একটু আলাদা। এসব কারণে অনেকেই মনে করতে  পারেন ওঁর গল্পে প্রচুর পরিমান যাদু বাস্তবতা আর মেটাফোর প্রয়োগের কারণে গল্পের ফ্লো বুঝি খানিক ঝিমিয়ে পরেছে অথবা থমকে গেছে।  আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমার ধারণা গল্পকার আশরাফ জুয়েল তার গল্পে মেটাফোরকে খুব যথাযথভাবেই ব্যাবহার করেন। একজন শিল্পী যেমন জানেন শিল্প নির্মাণে কোথায় কোন রংটা ঠিকমত লাগাতে হবে তেমনি জুয়েলও তাঁর গল্পে সেই কাজটি বেশ মুন্সিয়ানার সাথেই করেন।

শিল্পের কাজ কী? শিল্প কী শুধুই মুক্তির পথ বাতলে দেয়? সমাজ এবং রাষ্ট্রের চলমান অসংগতিগুলোর দিকে আঙুল উঁচু করে ধরে? আমি মনে করি না। যদি তাই হতো তাহলে শিল্প-সাহিত্য হয়ে উঠবে শ্লোগানে। কিন্তু শ্লোগনতো আর শিল্প নয়।  আমার ধারণা আশরাফ জুয়েল তার গল্পে এই দুটো কাজই খুব ঠান্ডা মাথায় করেন। তাঁর গল্পে যেমন শিল্প সাহিত্যের উপাদান থাকে পাশাপাশি তিনি গল্পের বয়ানে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে নির্মাণ করেন। পাঠক সেই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে তখন দেখতে তাদের চোখ দিয়ে দেখতে পান। তখন তার গল্পগুলো পাঠকের কাছে অন্যভাষায় ধরা দেয়। যে ভাষা দ্রোহের, যে ভাষা বিপ্লবের এবং আবার যে ভাষা কখনো কখনো নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার ভাষাও।

এবার তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘ পাখিরোষ’ এ খানিক বিচরণ করা যাক। গ্রন্থটি ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিলো। মোট ১০টি গল্প এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো হলো ছায়াসন্দেহ, সুখনিদ্রা পরিত্যাজে,জাগে মৃগরাজতেজে, একটি নোংরামূল্যের গল্প, গর্ভনাশ, ঘন বাতাসের সুলেমা, এত নিশ্চিন্ত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুরে খায় ক্যামনে?, অপ্রকাশিত ভাবনার কাফকা, বিজ্ঞাপিত সুখ, পাখিরোষ এবং হত্যাখামার। প্রতিটি গল্প নিজস্ব শক্তিতে বিদ্যমান। আবার প্রতিটা গল্পে রয়েছে অন্তর্নিহিত অসাধারণ কিছু ভাবনাও। আবার সবকটি গল্প দিয়ে একটি মালা গাঁথলে সেখানে ধরা পরে লেখকের মৌন দ্রোহ। যে দ্রোহ একজক পাঠকের আত্মায় দোলা দিতে বাধ্য। প্রতিটা গল্প পড়লে  এই অসম সমাজের অনেক অনাচার চোখে পড়ে। এই অনাচার জমে আছে রাষ্ট্রে, সমাজে এবং ব্যক্তি মানসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গল্পকার খুব সুকৌশলে সেই জমে থাকা ধূলোগুলোকে তাঁর গল্পের ভাষায় ঝাট দিতে চেয়েছেন।

তাঁর প্রথম গল্পটি হলো ছায়াসন্দেহ। আমার ধারণা এই গ্রন্থের খুব শক্তিশালী একটি গল্প। সাধারণ একটি বস্তুকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। মানুষ যে কথাটি বলতে পারে না, যে কাজটি করতে পারেন একটি বোতল, ছেড়া স্যান্ডেল, রাস্তায় ফেলে দেয়া চুইংগাম সে কথাটি বলতে পারে। এ যেনো আমাদের ছেলেবেলায় পড়া ব্যঙ্গমা বেঙ্গমির গল্পের মত। যে কথাটি মানুষের বলার কথা ছিলো সেই কথাটি লেখক খুব প্রতীকী ভাষায় একটি সাধারণ বস্তুর মুখ দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই ফিতাছেঁড়া বাটার স্যান্ডেলও বলে উঠতে পারে, ‘কি বুঝতে পারছেন?’ কিন্তু বাস্তবতা হলো ফিতাছেঁড়া স্যান্ডেলের যে কথাটি বুঝতে পারে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সেই কথাটি বুঝতে পারে না। লেখক এই গল্পটি দিয়ে আমাদের ঘুমিয়ে থাকা  আর নেতিয়ে পড়া সমাজকে আচ্ছারকম চপেটাঘাত করেছেন। তারপরও যদি এই আধমরাদাদের কিছুটা হলেও জাগরণ ঘটে!

কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছিলো। একটি পায়ে একটি স্যান্ডেল। সেই কাটা পা নিয়ে আশরাফ জুয়েলের আরেকটি গল্প। কত সুন্দর আর শৈল্পিকভাবেই  সেই একটি পায়ের নিঃসঙ্গতাকে গল্পকার না ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি পা মানেই একটি অস্বাভাবিক একাকীত্ব। সেই একাকীত্ববোধ নিয়ে আমরা নিত্যই ঘুরে বেড়ায়। এই গল্পটি বইয়ে সংকলোনের আগেই পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। দ্বিতীয়বার আবার পড়ার পর গল্পটি যেন আমার সামনে আবার নতুন করে ধরা দিলো। একজন স্বার্থতক গল্পকারের মুন্সিয়ানা বুঝি এখানেই। পাঠকের মনে গল্পের ডাইমেনশন নানা ভাবে নানা চিন্তায় গেঁথে দেয়ার ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। তাঁর ‘সুখনিদ্রা পরিত্যাজে, জাগো মৃগরাজতেজে’ গল্প থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না।

 ‘এই শুয়ে বসে থাকা। ভীষণ একা। কোথাও যাবার নেই। কোনো তাড়া নেই। ছোট একটি কেবিন। নাকের ফুটোর মতো একটা জানালা। সেটা দিয়ে নেমে আসা আধুলির সমান এক টুকরো আকাশ- সন্ধে নামলে সেই আকাশে অন্ধকারের সুতোয় ঝুলতে থাকে বেড়ালের চোখের মতো সাতটা তারা, একটি কপাট বন্ধ থাকলে তা নেমে আসে সাড়ে তিনটায়। দু-কপাট বন্ধ থাকলে মরে যায় আকাশটা। একটা ফ্যান নিশ্চিত ফাঁসির আসামির মতো ঝুলে থাকে। দেড় ধাপ সমান না-মাজা দাঁতের মতো একটা বাথরুম। বিছানাটা কবরের সমান।’

‘পাখিরোষ’ গল্পটি দিয়েই এই গ্রন্থের নামকরণ হয়েছে। এবং নামকরণ খুব যথাযথভাবেই হয়েছে। যে সমাজের মানুষ এখন বোবা, মুক এবং যে সমাজে মানুষের কথা বলার কোন শক্তি নেই সেই সমাজের মানুষ পাখি হয়ে আকাশে উড়বে এইতো স্বাভাবিক? গল্পটি আমাদের দেশের অবলা নারীদের নিয়ে। নারী নির্যাতন, নারীর অধিকার নিয়ে। যে নারীর কথা বলার শক্তি নেই, যে নারী প্রতিনিয়ত পুরুষ শাষিত সমাজে পণ্য হতে বাধ্য সেই নারীর মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াই বুঝি অপরাধ। তাই নারীরা পাখি হয়ে যায়। অথবা বলা যায় তারা পাখি হয়ে যেতে বাধ্য হয়। অসাধারণ যাদু বাস্ববতা দিয়ে আশরাফ জুয়েল এই সমাজের একটি বাস্তব চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গল্পে।

 ‘একটি নোংরামূল্যের গল্প’ আমার আরেকটি সুখপাঠ্য গল্প। আমাদের সমাজের প্রান্তিকদের নিয়ে লেখা এই গল্প। যারা নেশা করে, ভিক্ষা করে, প্রতারণা করে আবার নানা রূপ নিয়ে জীবন বাস্তবাতায় তাদের টিকে থাকতে হয় সেই নিম্নবর্গদের নিয়ে লেখা এই গল্পটিও মূলত আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজটিকেই চিত্রিত করেছে। গল্পটি পড়লে আমাদের ক্লেদাক্ত সমাজ আর সেই সমাজের কিছু বিভৎস মানুষের ছবি আমাদের অন্তারাত্মায় ভেসে উঠে।  ঠিক এমন অবক্ষয়ের আরেকটি চিত্র দেখতে পাই তাঁর ‘এত নিশ্চিন্ত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুরে খায় ক্যামনে?’ গল্পে। একদিকে শিল্পপতি পিতা যিনি পুঁজিবাদকে ধারণ করেন অন্যদিকে সেই পিতার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে থাকা সন্তানের প্রতিবাদ। এভাবে ধরে ধরে তাঁর প্রতিটা গল্পই আলোচনা করা যেতে পারে। প্রতিটা গল্পেই ধরা পড়বে নতুনত্ব আর নতুন নতুন ভাবনার খোরাক।

আগেই উল্লেখ করেছি আশরাফ জুয়েল মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন কবি। তার গল্পে কবিতার মতো অনেক চিত্রকল্প স্থান পাবে এই স্বাভাবিক। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। ‘আধুলির সমান এক টুকরো আকাশ’, ‘নাকের ফুটোর মতো একটা জানালা’, ‘বর্ষার কাঁচামাটির গর্ভবতী চুলোর মতো অবস্থা যেন’, ‘নতুন খুশকির মতো জ্বালাতন করছে ভাবনাটা’, ‘পশ্চিম মানে মাতবর’, ‘এক চোখ ধর্মের তো আরেক চোখ মাতালের। এক চোখ ব্যবসার তো আরেক চোখ ডাকাতের’। এমন অনেক উদাহারণ  দেয়া যাবে। এই মেটাফোরগুলো আশরাফ জুয়েলের গল্পের অন্যতম অলংকার বলে আমি মনে করি। সবাই এত গভীরভাবে সমাজকে দেখতে পারেন না। সমাজের অনাচারগুলোকে কাব্যিকভাবে তুলে আনা এত সহজও নয়। গল্পকার আশরাফ জুয়েল সেই কঠিন কাজটি করেছেন। আবার গল্প লেখার জন্য সিগারেট, মশা, স্যান্ডেলের ফিতা, ফুল হাতা শার্টের পকেট, বাদামের খোসা, বৃদ্ধ চশমা, আধপোড়া একটা সিগারেট মত খুব সাধারণ এই বস্তুগুলো দিয়ে তিনি অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করেছেন, পাঠককে নানাভাবে গল্পের চরিত্রের সঙ্গে ডুবিয়ে রেখেছেন। একজন জাত লেখক না হলে এই কাজটি করা এত সহজ নয়। গল্পকার আশরাফ জুয়েলকে সাধুবাদ।

’পাখিরোষ’ গ্রন্থটির অসাধারণ নান্দনিক প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী তাইফ আদনান। তাঁকে অভিনন্দন। গ্রন্থটি পাওয়া যাবে ঐতিহ্য প্রকাশনী এবং অনলাইন বইয়ের দোকানগুলিতে।

’পাখিরোষ’ গল্পগ্রন্থটি পাঠকের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াক এই প্রার্থনা।

 হেপি রিডিং..

Leave a Reply