You are currently viewing ডেজার্ট এন্ড দি সী

ডেজার্ট এন্ড দি সী

সোমালিয়া ডাকাত দলের সাথে ৯৭৭ দিন!

ডেজার্ট এন্ড দি সী

সোমালিয়া ডাকাত দলের সাথে ৯৭৭ দিন!

আদনান সৈয়দ

বর্তমান সময়ে ম্যানহাটনের সবচেয়ে আদি এবং বনেদি বইয়ের দোকানের নাম হল ’স্ট্র্যন্ড(strand)। আপনি পুরনো আর দুস্প্রাপ্য কোন বই খুজছেন? পাচ্ছেন না? তাহলে আপনাকে অবশ্যই স্ট্র্যন্ডমুখি হতে হবে। ম্যানহাটনের ঠিক ডাউনটাউনের কাছাকাছি বিশাল আর বনেদি এই বইয়ের দোকান। স্ট্র্যন্ডের আরেক বিশেষ গুণ হল ”বুক সাইনিং সন্ধ্যা”র আয়োজন। এই বিশেস সন্ধ্যায় আমেরিকাতো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামিদামি লেখকগন তাঁদের বই নিয়ে কথা বলেন আর সেই সঙ্গে পাঠকের মুখোমুখি হোন।  স্ট্র্যন্ডে পুরাতন আর দুস্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ রিতিমত ঈর্ষার কারণ হয়ে দাড়ায়। স্ট্র্যন্ড দাবি করে তাদের সংগ্রহে থাকা বইগুলো ইটের মত পাশাপাশি রাখলে তা লম্বায় হবে ১৮ মাইল! আরেকটা বিষয় হল তাদের বইগুলোর বাজার মূল্য অন্যান্য বইয়ের দোকানের তুলনায় অনেক সস্তা। আপনার কপাল যদি ভালো থাকে তাহলে মাত্র এক কি দুই ডলারের বিনিময়ে আপনি পেয়ে যেতে পারেন থমাস ম্যানের দুস্প্রাপ্য কোন একটা বই!   শুধুমাত্র এই বিশেষ কারণেই ’স্ট্র্যন্ড’ এর সাথে বইপ্রেমিদের সঙ্গে আলাদা একটা সখ্য তৈরি হয়েছে।

গত বছর বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে স্ট্র্যন্ডে এর ’বুক সাইনিং সন্ধ্যায়’ এসেছিলেন জনপ্রিয় লেখক সময়ের খুব জনপ্রিয় লেখক মাইকেল স্কট মুর। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ’দি ডেসার্ট এন্ড দি সী’  তখন  জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। গ্রন্থটির বুক সাইনিং সন্ধ্যায় আমি নিজেও উপস্থিত থাকতে পেরে আনন্দে রিতিমত গদ গদ হয়ে আছি। ম্যানহাটনে ব্রডওয়ের ১২তম সড়কের কোনায় দাড়িয়ে থাকা স্ট্রান্ড বুক স্টোরের তিন তলা মিলনায়তনে ঢুকে দেখতে পেলাম আসনগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কিছুক্ষন পরই পিনপতন নিরাবতা ভেঙে মাইকেল স্কট মুর মঞ্চে এলেন। সাধারণ কুশল বিনিময় এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিনি তাঁর গ্রন্থটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।  মুর যখন তাঁর গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন তখন আমাদের মানসপটে সোমালিয়ার ভয়ংকর জলদস্যুদের চেহারা ভেসে আসছিল। পিনপতন নিরাবতায় তখন  আমরা অধির আগ্রহে গিলছিলাম লেখকের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা।

মাইকেল স্কট মুর একজন আমেরিকান সাংবাদিক এবং লেখক। ২০১২ সালে তাকে সোমালিয়া পাঠানো হয়েছিল সেখানকার দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস জলদস্যুদের উপর প্রতিবেদন করতে যেয়ে তিনি নিজেই তাদের হাতে বন্দী হয়ে পরেন। শুরু হয় মাইকেলের কঠিন এক বন্দী জীবন। টানা ৯৭৭ দিন তিনি ডাকাত দলের হাতে বন্দী ছিলেন। বন্দী দশায় তাকে শারিরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তিনি শারিরিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পরেন। কিন্তু তারপরও মানসিক শক্তির কাছে তিনি পরাজিত হন নি। সোমালিয়ার জলদস্যুর দল তার মুক্তিপণ দাবী করেছিল ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! হয় কুড়ি মিলিয়ন ডলার নয়তো মরদেহ! এত বড় অংকের টাকা মাইকেলের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু লস এঞ্জেলেস এ থাকা তার মা এ খবরে একবারেই দমে যান নি। ছেলের মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে তিনি মাঠে নেমে পরেন। তার মারে সাথে যোগ দিলেন সেখানকার কিছু মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব, এবং বড় বড় ব্যাবসায়ী স¤প্রদায়। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে তারা সবাই মিলে ১.৬ মিলিয়ন ডলার জোগার করেন। সেই টাকায় সোমালিয়ার ডাকাতদলের সঙ্গে আমেরিকা সরকারের একটা রফাদফা হয় এবং মাইকেলকে মুক্ত করা। মুক্তি পেয়েই তিনি দীর্ঘ দিন চিকিৎসা সেবায় চলে যান। তারপর সুস্থ হয়ে উঠেই সেই ভয়বাহ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন অসাধারণ এই বইটি। অনেকটা জার্নাল এবং আত্বজীবনী মিশ্রনে লেখা গ্রন্থটি  আমেরিকার সেড়া বইয়ের তালিকায় উঠে আসে। গ্রন্থটির নাম ‘ দি ডেজার্ট এন্ড দি সী’ প্রকাশক হারপার ওয়েভ।

টানা পয়তাল্লিশ মিনিট লেখক গ্রন্থটি নিয়ে কথা বললেন। গ্রন্থটি সম্পর্কে বলতে যেয়ে তিনি মূলত তার বন্দীকালীন সময়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে টানা  ৯৭৭ দিনের রোজনামচার কথাই বর্ণনা দেন। কখনো কখনো সেই বর্ণনায় ছিল শ্লেষ, কখনো বুক উজার করে দেওয়া শ্লোষাত্বক হাসি আবার কখনো ছিল বুক চাপা কান্না। উপস্থিত লোকজন লেখকের এই কথাগুলো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শুনেছেন, কখনো অবাক হয়ে চোখ উপরে তুলেছেন আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়িও খেয়েছেন। কেউ কেউ দেখেছি গোপনে পকেট থেকে টিসু পেপার বেড় করে গোপনে চোখটিও মুছে নিয়েছেন। কিন্তু লেখক যতক্ষন পর্যন্ত মিলনায়তনে ছিলেন ততক্ষন পর্যন্ত তার পাঠককুল যেন আঠার মত তাঁর কথা শুনছিলেন। অবশ্য আগেই বলেছি বইটির বিষয়ই এর অন্যতম কারণ। কাঠখোট্টা কোন বিষয় নয়। সিনেমার কোন গাল গপ্পও নয়। রিতিমত জলদস্যুদের নিয়ে বাস্তব জীবনের গল্প!  যে ভয়াবহ আর দুর্ধর্ষ সোমালিয়া ডাকাতদের কথা আমরা পত্র পত্রিকায়, টিভিতে বা সিনেমায় দেখতে পাই সেই খোদ ডাকাতদল অপহরণ করলো আমোরিকারই এক সাংবাদিককে! এই বিষয়টিকে ভেবে লেখকের প্রতি পাঠকের সহমর্মী হবে হবে এই স্বাভাবিক। আরেকটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। সেটি হল লেখককের কলমের দক্ষতা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে লেখক বুঝি গ্রন্থটিতে তার বন্দী জীবনের গল্পটি বলছেন কিন্তু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার সেই বর্ণনার গভীরে যেমন রয়েছে সমাজ এবং রাষ্ট্রযে্ন্ত্রর প্রতি সূক্ষ কটাক্ষ আবার সেই সাথে  বর্তমান দুনিয়ার ধর্মীয় উন্মাদনা, নৈতিক স্থলন, ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার কঠিন চেহাড়াটাও সমানভাবে তিনি তার গ্রন্থে তুলে এনেছেন।

 চট করে লেখক মাইকেল স্কট মুর সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যেতে পারে। জন্ম ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস শহরে। পড়াশুনা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৯১ সালে তিনি জার্মান সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানিতে চলে যান এবং সেখানে জার্মানির নাগরিকত্ব নিয়ে স্পাইজেল অনলাইন পাত্রিকায় যোগ দেন। আমেরিকায় তিনি ‘ দি আটলান্টিক মান্থলি, দি নিউ রিপাবলিক, লস এঞ্জেলেস টাইমস সহ অনেক পত্রিকার নিয়মিত লেখক।

আবার বই স্বাক্ষর সন্ধ্যায় চলে যাওয়া যাক। মাইকেলে এর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই লেখক—পাঠক প্রশ্ন—উত্তর পর্ব শুরু হয়ে যায়। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল লেখককে কোন সরাসরি কোন প্রশ্ন করা যাবে না । উপস্থিত সবার লিখিত প্রশ্নের উত্তরই তিনি শুধু দিবেন। উপস্থিত দর্শকদের কিছু প্রশ্ন এবং সেই সঙ্গে লেখকের দেওয়া উত্তর আপনাদের কৌতুহলের কথা ভেবে নিচে তুলে ধরছি।

প্রশ্নঃ আপনাকে জলদস্যুদল জিম্মি করলো এবং দাবী করলো যে ২০ মিলিয়ন ডলারের মুক্তিপণের বিনিময়ে আপনাকে আমেরিকা সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। টাকার পরিমানটা খুব বেশি হয়ে গেল না? ডাকাতদলরা কী জানে ২০ মিলিয়ন কত পরিমান টাকা?

মাইকেল স্কট মুরঃ ডাকাত দল ভেবেছিল যেহেতু আমি আমেরিকার নাগরিক সে কারণে হয়তো আমেরিকা সরকার কুড়ি মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাদের সঙ্গে একটা রফাদফা করে আমাকে মুক্ত করে আনবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সরকার থেকে আইনি সহায়তা ছাড়া আমি তেমন কিছুই পাইনি। তবে এফবিআই আমাকে অনেক সহযোগীতা করেছে। সবচেয়ে বেশি সহযোগীতা পেয়েছি আমার বৃদ্ধা মা’র কাছ থেকে। তাঁর ব্যাক্তিগত উদ্যোগে, আমার সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান এবং কিছু মানবতাবাদি মানুষদের সহযোগীতায় তারা  ১.৬ মিলিয়ন ডলার জোগার করতে সমর্থ হয়েছিল। তাদের এই আন্তরিক পরিশ্রমের কারণেই আজ আমি আপনাদের সামনে এসে কথা বলতে পারছি। আমার মা যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার দ্বারে দ্বারে যেয়ে আমার জন্যে টাকা চেয়েছেন তা রিতিমত আমাকে বিস্মিত করে! আমার গ্রন্থে সে নিয়ে বিস্তর বর্ণনা আছে।

প্রশ্নঃ আপনাকে কীভাবে তারা নির্যাতন করেছিল?

মাইকেল স্কট মুরঃ আমাকে প্রায় প্রতিদিনই যখন তখন প্রহার করা হত। এই দেখুন পিঠে এখনো দাগ লেগে আছে। পিঠটাও কেমন বাকা হয়ে গেছে। আর নির্যাতন ছিল খাবার দাবারেও। কোন খাবার দিত না। খাবারের জন্যে চিৎকার করতাম। সেই অমানবিক অত্যাচার বর্ণনা করা যাবে না। সেই ভাষা লেখাও যাবে না।

প্রশ্নঃ দীর্ঘ ৯৭৭ দিন আপনি ছিলেন এই বর্বর জলদস্যুদের সঙ্গে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে আপনার প্রতিটা সময় ছিল কঠিন, কষ্টে জর্জরিত। তারপরও বলি, এই ডাকাতদলের সঙ্গে থেকে আপনার বিচিত্র কোন অভিজ্ঞতা হয়েছিল কী?

মাইকেলঃ অনেক ধন্যবাদ। হ্যা, অবশ্যই হয়েছিল। যেমন ধরুণ আমি ওদের একটি বিয়েতে থাকতে পেরেছিলাম। ডাকাতদলেরর একজন বিয়ে করবে। আমাকে বললো যে আমিও যেন তাদের সঙ্গে বরযাত্রী হিশেবে যাই। বিষয়টা আমার জন্যে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা বৈকি! একদিকে মুক্তিপণের টাকার জন্যে তাগাদা এবং মৃত্যু ভয়, অন্যদিকে ওদেরই বরযাত্রি হয়ে বিয়েতে যোগদান। ভাবুন! আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি দীর্ঘ আড়াই বছরে ছোট একটা ঘরে বন্দীদশায় শুধুমাত্র বাইবেল ছাড়া আর কোন কিছু পড়ার সুযোগ পাইনি। যার ফলে গোটা বাইবেল আমি তিনবার আপাদমস্তক পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম।

প্রশ্নঃ ডাকাতদলের কারো সাথে কোন সখ্য হয়েছিল আপনার? ।

মাইকেলঃ ভালো প্রশ্ন। সম্পর্ক ঠিক বলা যায় না তবে এক তরুণের সঙ্গে আমার অনেক ব্যাক্তিগত কথাবার্তা হত। এই যেমন ধরুণ সে তার জীবনের পরিকল্পনার কথা আমাকে বলতো। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছিল সে একদিন ডাকাতি পেশা ছেড়ে দিয়ে সোমালিয়া ত্যাগ করে কোন ইউরোপিয়ান অথাব উন্নত দেশে চলে যাবে। আর তাছাড়া আমি আরেকটা কাজও করেছিলাম। ডাকাতদলদের আমি ইয়োগা শেখাতে শুরু করেছিলাম। তারা বেশ মজা পেত। আমিও কষ্টের মধ্যে আনন্দ পেতাম।

এভাবে হঠাৎ করেই নিউইয়র্কের ম্যানহাটন শহরটি গরম রোদ থেকে মুক্ত হয়ে সন্ধ্যার নরম চাদরে ডুবে গেল। তখন শুধু বাড়ি ফেরার তাড়া। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মানসপটে শুধু সোমালিয়ার কিছু কালো জলদস্যুদের  চেহারাই ভেসে আসছিল। ভাবছিলাম, তাদের চোখও কি ছিল লাল আর কানেও কি গুজা ছিল রক্ত জবা ফুল?

Leave a Reply