উপন্যাসের নামঃ ধুতুরা জোছনার দিন
লেখকঃ শাহাব আহমেদ
প্রকাশকঃ বিদ্যাপ্রকাশ
প্রচ্ছদঃ রাকীব হাসান
নিউ ইয়র্ক বইমেলা থেকে সদ্যই হাতে এসেছে কথাসাহিত্যিক এবং ভ্রমন বিষয়ক লেখক শাহাব আহমেদের উপন্যাস ‘ধুতুরা জোছনার দিন’। প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। উপন্যাসটির নামটি শুনেই হয়তো অনেকেই চিন্তায় পড়ে যাবেন! ধুতুরা/জোছনা/দিন। এই তিনটি শব্দের মধ্যে কোনো যুতসই সম্পর্ক আছে কি? আমার ধারণা উপন্যাসটি পাঠ শুরু করলে পাঠক নিজেই এই রহস্য ধরে ফেলতে পারবেন। আমি বিষয়টি এভাবে দেখেছি। ধুতুরা ফুলের রং সাদা। কিন্তু এর ভেতর থাকে বিষ। আবার জোছনার রং সাদা। লেখক তাঁর উপন্যাসে যে সময়কে ধারণ করেছেন তখন আধুনিক বিজলী বাতি ছিল না। জোছনার আলোতেই ছিল মানুষের সাদামাটা সহজ সুন্দর জীবন। আবার সাদা রং মানে পবিত্র, সুন্দরের প্রতীক। একসময় এই সুন্দরকে নিয়েই ছিল মানুষের বসবাস। ধুতুরা ফুলও দেখতে সুন্দর। কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে বিষ। এই বিষ একসময় মানুষের অন্তরে লালন করা সেই সুন্দরকে হত্যা করেছে, নষ্ট করেছে, কব্জাও করে নিয়েছে।
এই উপন্যাসটির মূল বিষয় হল ‘সময়’। একটি সময়কে তিনি এই উপন্যাসের ফ্রেমে বন্দি করেছেন। ফরাসি কবি এবং কথাসাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্ত যেমন করে তাঁর, ‘In Search of Lost Time’ উপন্যাসে তাঁর ছেলেবেলা, শৈশব এবং কিছু অসাধারণ স্মৃতি তুলে এনেছেন এবং সেসব স্মৃতি বর্তমান সময়ে বেঁধেছেন কথাসাহিত্যিক শাহাব আহমেদের উপন্যাস ‘ ধুতুরা জোছনার দিন’ ঠিক যেন তাই। উপন্যাসটি পাঠককে তরতর করে নিয়ে যাবে পদ্মার চরে, বিক্রমপুরের একটি গ্রামে, কখনো বিস্তর মিয়ার উঠোনে তরমুজ রং এর পাকা পেয়ারার গাছে যেখানে লেজ উঁচিয়ে দোয়েল সারাক্ষণ নাচানাচি করে। এই উপন্যাস পড়তে পড়তে বালক আসিফেরে চোখ দিয়ে পাঠক দেখতে পাবেন একটি সময়ের বাক বদলের ইতিহাস। যে ইতিহাসে বাঁধা পরে থাকে একটি দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, কূটকৌশলসহ আরো কত কত কী! মানুষ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে যায়। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভেতরে যে ‘মানুষ’টি বসবাস করতো সেই ‘মানুষ’সত্তাটিও চোখের সামনেই যেন হারিয়ে যায়। এ যেনো অন্য এক সময়!
দেখতে পাই এই হারিয়ে যাওয়া ‘সময়’ এর খোঁজে আরো অনেক লেখালেখি হয়েছে। তার্কিশ লেখক ওরহান পামুক তাঁর ‘ ইস্তাম্বুল’ উপন্যাসেও এই হারিয়ে যাওয়া সময়কে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই সোনালি শৈশোব কোথায় যেন চিরতরেই হারিয়ে গেছে। পামুক সেই হারানো বেদনাকে বলেছেন, ‘ Sweet Melancholy’ অর্থাৎ মিষ্টি বিস্বাদ’। যে মিষ্টতা এখনো প্রাণে দোলা দেয় কিন্তু বাস্তবে আর তার দেখা পাওয়া যায় না।
সেই গৌরবময় ‘সময়’কে হারিয়ে আমরাও কি প্রতিনিয়ত রক্তাত্ব হই না? দশক ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে প্রতিটা দশকেই আমরা একটু একটু করে আমাদের ঐতিহ্যের সময়কে হারিয়েছি। উপন্যাসটিতে ষাট, সত্তর এবং আশির দশকের সময়ের যে বাক বদল হয়েছে সেই বাককে এই উপন্যাসটিতে তুলে আনা হয়েছে। পুরো উপন্যাসটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগের নাম দেয়া হয়েছে ‘দূর্বা ঘাসে ওস’ এবং দ্বিতীয় ভাগের নাম ‘হাওয়া দোলে আকন্দের ডালে’। প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ মিলেই এই গোটা উপন্যাস। প্রথমভাগটিকে বলা যেতে পারে ‘সময়ে’র প্রকৃতি রূপ। আর দ্বিতীয়ভাগ হলে ‘সময়ে’ এর ক্রমবিকাশ রূপ বা হারিয়ে যাওয়া রূপ। কবি উইলিয়াম ব্ল্যাক তাঁর কবিতায় যেমন মানুষের ‘Innocence and Experience’ দুটো পর্যায়কে নিয়ে এসেছেন ঠিক তেমনি শাহাব আহমেদ এর উপন্যাসটিতেও মানুষের দূর্বা ঘাসের ওসের মত সহজ সরল জীবনের ছবি এঁকেছেন এবং দ্বিতীয়ভাগে মানুষের চাওয়া পাওয়ার হিসাব, লোভ, ক্ষমতা, বিত্তের বাহাদুরি আকন্দের ডালে কীভাবে ঝুলে আছে সেই চিত্রটিও এঁকেছেন।
উপন্যাসটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল লেখককের বর্ণনার সহজ সরল ভাষা। এই ভাষা প্রাণকে স্পর্শ করে, ছুঁয়ে যায়। মনে হয় কিছু সময়ের জন্য আমি নিজেও বুঝি সেই বিক্রমপুরের কোন গ্রামে চলে গিয়েছিলাম! বুকের ভেতর কেমন জানি এক হাহাকারের জন্ম নেয়। এক মায়াময় স্মৃতিকাতর জীবনের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়। একটি উদাহারণ দিই।
‘বাইরে নৈঃশব্দের বুক চিরে বিরহে কাঁদছে নিঃসঙ্গ ঘুঘুপাখি। সোনাঝরা দুপুর। এ কি শুধুই আমার পিতার পায়ের নিচে মায়ের জান্নাতের অনুসন্ধান? নাকি তার চেয়েও বড় কিছু; পার্থিব, কোমল ও সুন্দর? ভালোবাসা কারে কয়? বৃক্ষ-বাকলকে প্রশ্ন করে দেখো।’(পৃষ্ঠা-৮৫)
‘ধুতুরা জোছনার দিন’ উপন্যাসটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাকীব হাসান।
লেখককে অভিনন্দন!