You are currently viewing নারীর ভাগ্য জয়ের অধিকার

নারীর ভাগ্য জয়ের অধিকার

লেখকঃ ম্যারি উলস্টোনক্রাফট

(A Vindication of the Rights of Woman: with Strictures on Political and Moral Subjects by Marie Wolfstonecraft)

প্রকাশকঃ সুবর্ণ

ভাষান্তরঃ মোবাশ্বেরা খানম

পাঠ প্রতিক্রিয়া লিজি রহমান

অধ্যাপক ড. মোবাশ্বেরা খানম, আমাদের বুশরা আপা, অনূদিত বইটি যখন এ বছর প্রথম প্রকাশিত হয় তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল বইটি পড়ার। দেশে আসার পর বইটি হাতে পেলাম। পড়বো বলে বুশরা আপার বাসা থেকেই নিয়ে আসি এবং সঙ্গে সঙ্গেই পড়া শুরু করে দিই। কিন্তু ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকার জন্য বইটা পড়ে শেষ করতে সময় লেগে গেলো। মূল বইটা না পড়লেও অনলাইনে বইটার যতোটুকু পড়েছি তাতে শ্রদ্ধাবনত হতে হয় বুশরা আপার ঝরঝরে সহজ ও স্বচ্ছন্দ গতিতে লেখা বাংলা বইটি পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর খটমটে ইংরেজিতে লেখা বইটিকে তিনি যথেষ্ট সহজবোধ্যভাবে বাংলায় তুলে ধরেছেন। দুটো ভাষার ওপর পারদর্শীতা না থাকলে এটা কিছুতেই সম্ভব হতো না।

বইটি পড়তে গিয়ে আমাকে বারবার থামতে হচ্ছিল। অনেক ছত্রই একাধিকবার পড়তে হয়েছে। কারণ মূল বক্তব্যে আসার আগে লেখক একই কথা নানাভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বারবার বলছিলেন। এর কারণ হয়তো আর কিছুই না। লেখকের সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর লেখার স্টাইল।

ম্যারি উলস্টোনক্রাফট ছিলেন আধুনিক ফেমিনিস্টদের একজন অগ্রদূত। যে সময়ে তিনি বইটা লিখেছেন সে সময়ে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলাটা ছিল দুঃসাহসিকতার কাজ। এখন উন্নত তো বটেই, অনুন্নত দেশগুলোতেও নারী রাষ্ট্রনেতা হওয়াটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় না, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে নারীদের রাষ্ট্রীয় কর্মে অংশ নেবার কথা ভাবাটাও ছিল হাস‍্যকর। অথচ ম‍্যারি উলস্টোনক্র‍্যাফ্ট সে সময় এই বইয়ের শুরুতেই লিখেছেন, “হয়ত আমার কথায় অনেকের হাসি পাবে, তবু আমি একটি ইঙ্গিত দিতে চাই, যেটি ভবিষ্যতে কখনো হতে পারে। কারণ আমি সত্যি মনে করি সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বে মেয়েদের প্রতিনিধি থাকতে হবে। মেয়েদের অংশীদারিত্ব ছাড়া অযৌক্তিকভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড চালিত হতে পারে না।”

তখনকার প্রেক্ষাপটে নারী মুক্তির কথা বলতে গিয়ে তাকে অনেক ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়েছে। নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে তার বক্তব্যের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে আরো অনেক মতামতের উদ্ধৃতি দিতে হয়েছে। এখনকার (বাংলাদেশের) মত তখনকার ইংল্যান্ডেও ধর্মগুরুদের রুষ্ট করা বিপদজনক ছিল। তাই তারা যাতে অসন্তুষ্ট না হন, সেজন্য তিনি কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিয়েছেন। সরাসরি নিজের বক্তব্যকে পেশ করতে পারেননি।

এই বইটি পড়ে আমার যা মনে হলো, অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা এই বইটির গুরুত্ব একবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের জন্য এটি খুবই প্রযোজ্য। যেমন ম্যারি উলস্টোনক্রাফট লিখেছেন, “আমরা যদি লক্ষ করি দেখতে পাব, যাদের কাছ থেকে পুরুষেরা জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়ার ভাণ করে, তাদেরকেই তারা সবচেয়ে বেশি তুচ্ছ জ্ঞান করে।”

তার এই কথাটির সাথে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত অনেক বাঙ্গালি নারীর জীবনকাহিনীর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। সংসারে তার প্রকৃত অবস্থানটা কোথায় সেটা বুঝতে পারবেন এবং মনে মনে নিশ্চয়ই একমত হবেন। তাদের স্বামীরা যে তাদেরকে শয্যাসঙ্গিনী এবং রাঁধুনির ভূমিকার বাইরে প্রকৃত সঙ্গী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে কতোটুকু সম্মান করেন, সেটা চিন্তা করবেন। অনেক শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী নারীকেও সবসময় স্বামীর ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে দেখেছি। এই বই তাদের জন‍্য। তাদের স্বামীদের জন্য।

ম্যারি উলস্টোনক্রাফট লিখেছেন, “মেয়েদের কাছ থেকে সদগুণ প্রত্যাশা করা বৃথা যদি না তারা কিছুটা হলেও পুরুষদের থেকে মুক্ত হয়। এটা আশা করাও বৃথা যে ভাল মা ও স্ত্রী হওয়ার মতো স্বাভাবিক ভালবাসার শক্তি তাদের থাকবে। যখন তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল তাদের স্বামীর ওপরে! তখন তারা ধূর্ত হবে, হবে সংকীর্ণ চিত্ত ও স্বার্থপর।” এই কথাগুলোও বাংলাদেশী অনেক নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ‍্য। কারণ তারা বিয়ের পর সম্পূর্ণভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল থাকেন। পড়াশোনা করে নিজের মনকে পরিশীলিত করার এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনো আগ্রহ বা চেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। অলস আড্ডা এবং রূপচর্চা করেই তাদের সময় পার হয়। মনে সংকীর্ণতা আসে। তারা কিভাবে তাদের সন্তানকে সুশিক্ষিত করবেন?

নারীর সার্বিক মুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ম্যারি উলস্টোনক্রাফট তার এই দীর্ঘ গ্রন্থে অনেক বিষয়েরই অবতারণা করেছেন। নারী পুরুষের সম্পর্ক, নারী পুরুষের সমানাধিকার, শিক্ষা, জীবিকা, মানসিক বিকাশ, সন্তান পালন, রাজনীতি, ধর্ম, সামাজিক আচার, শারীরিক বিকাশ, ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়েই তিনি তার সময় অনুপাতে বৈপ্লবিক আলোচনা করেছেন।

ম্যারি উলস্টোনক্রাফট উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, “মেয়েদেরকে প্রাণী হিসেবে গড়ে তোল এবং মুক্ত নাগরিক হিসাবেও। তারা দ্রুতই ভালো স্ত্রী এবং মা হয়ে উঠবে। তার মানে অবশ্যই যদি ছেলেরা স্বামী ও বাবার দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করে।” এই কথাগুলোও কি আমাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়?

আমার মনে হয়, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি নারী পুরুষেরই উচিৎ কষ্ট করে এই বইটি পড়া। তাহলে তারা দেখবেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড আর একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের সমাজ ব‍্যবস্থা এবং নারীদের প্রতি পুরুষের মানসিকতার বিশেষ পার্থক্য নেই। আমার মনে হয় স্কুল কলেজে এই বইটি বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো উচিত। এতে করে ছেলেমেয়েরা বইটিকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেনা এবং বইটি তাদের মানসিক ও চারিত্রিক বিকাশে সাহায্য করবে।

ধন্যবাদ বুশরা আপা, এমন একটি দুরূহ কাজকে এতো সুন্দরভাবে বাঙ্গালি পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য। বইটির ব্যাপক প্রসার কামনা করছি।

 

 

 

Leave a Reply