You are currently viewing লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার  এবং আমাদের মানস

লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার এবং আমাদের মানস

লেখকঃ ডি. এইচ. লরেন্স

প্রকাশকঃ পেঙ্গুইন

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আদনান সৈয়দ

সন্দেহ নেই ডি.এইচ.লরেন্স তাঁর ` লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটি দিয়ে সমাজে বড় একটি আলোড়ন তৈরি করেছিলেন। সেই আলোড়নের ঢেউ পশ্চিম থেকে আমাদের প্রাচ্যের ঘাটেও এসে বাড়ি খেয়েছে। লরেন্সের মারা যাওয়ার একত্রিশ বছর পর ১৯৬১ সালে পেঙ্গুইন যখন বইটি প্রকাশ করলো তখন গোটা পৃথিবীতেই বইটি নিয়ে এক হুলস্থুল কান্ড শুরু হয়ে গেল! দু:খের বিষয় ডি.এইচ  লরেন্স তাঁর জীবিতকালে এই হুলস্থুল কান্ডটি দেখে যেতে পারেননি ।  তৎকালীন সময়ের রক্ষণশীল সমাজের তোপের মুখে লরেন্স উপন্যাসটি প্রকাশ করতে পারেননি। ১৯২৮ সালে উপন্যাসটি খুব গোপনে ফ্লোরেন্সে প্রকাশিত হলেও সেই উপন্যাস আলোর মুখ দেখতে লেগেছিল আরো ৩১ বছর!

 প্রশ্ন আসতে পারে উপন্যাসটি নিয়ে কেন এত হৈচৈ? কেন উপন্যাসটি ইংল্যান্ডের মত আধুনিক শিল্প সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র বলে পরিচিত জায়গাতেই নিষিদ্ধ হয়েছিল! উপন্যাসটির পটভুমিকাই কি এর কারণ? শুধুই যৌনাতা? নাকি অন্য কিছু? লক্ষ্য করুণ শিল্প সাহিত্যে যৌনতার উপস্থিতি নতুন কোন ঘটনা নয়। শিল্পের সেই আদিকাল থেকেই শিল্পীর তুলিতে যৌনতা স্থান পেয়েছে। আর যৌনতাতো জীবনেরই একটা অংশ! তাই নয়কি? কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন সময়ে সমাজের একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী এই ’যৌনতা মানেই অশ্লীলতা’ এই অযুহাতেকে সামনে এনে শিল্পীর কন্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে নানা রকম ষড়যন্ত্র ফেদেছে, শিল্পকলাকে হুমকি দিয়েছে— সেই ইতিহাসও আমরা জানি। কিন্তু প্রশ্ন হল ইংল্যান্ডের সুধী সমাজ কেন মনে করলো যে ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’  যৌনাতপুষ্ট একটি উপন্যাস এবং এই উপন্যাসটি সমাজের জন্যে ক্ষতিকারক। অতএব এর গলা টিপে হত্যা করা জরুরী!  আর যৌনতার কথাও যদি ধরি তাহলেও বলবো সমাজের চোখে যৌনতা মানেই অশ্লিলতা আর নিষিদ্ধ অন্ধকার জগৎ! না, যৌনতা নিয়ে আমরা সমাজে খোলামেলা কথা বলা বারণ আছে। যৌনতার সঙ্গে বসবাস করা যায় কিন্তু কথা বলা যায় না। যৌন সম্পর্ক নিয়ে কথা বললে এই সমাজের রক্ষণশীলরা বাঁকা চোখে তাকান। তবে ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটির নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনের কারণ অন্যটি। সে কারণ যৌনাতার চেয়েও আরো বেশি ভয়াবহ ! সেটি হল একজন রক্ষণশীল উচ্চ শ্রেণীর নারীর সঙ্গে একজন সাধারণ নীচু শ্রেণীর মানুষের প্রণয় । এই অসম প্রণয় রক্ষণশীল সমাজের গালে চটি মারার চেয়েও কোন অংশে কম নয়! এর অন্তর্নিহিত কারণ খুজতে আমাদের সামনে দুটো বিষয় ধরা পরে। প্রথমত  শ্রেণী বৈষম্য আর দ্বিতীয়ত হল ক্ষমতা। সমাজে শ্রেণী বৈষম্য লালন করে নিজের দাপট, ক্ষমতা এবং বিত্তের উপর পা দিয়ে সমাজকে যারা শাষন এবং শোষন করতে অভ্যস্থ তাদের কাছে ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’  আদরনীয় কোন শিল্প হওয়ার কথা নয়।

লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার শুধুই কি একটি উপন্যাস! শুধুই কি যৌন উদ্দিপক গল্প! প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তোর ইংল্যান্ডের ভুস্বামী, নাইট , ভাইসরয়সহ উচ্চশ্রেণী তথাকথিত আভিজত্যের মোড়কে যখন সমাজ যখন আবদ্ধ ঠিক তখন এ ধরনের একটি উপন্যাস এই শ্রেণী শোষকদের জন্যে বড় রকমের হুমকি হবে এই স্বাভাবিক। ধারণা করি লরেন্স সেই সমাজকে খুব কাছ থেকেই দেখে থাকবেন। তবে শুধু রক্ষণশীল শ্রেণী শোষকের কথাই বা কিভাবে বলি! লরেন্সের সমসাময়িক প্রচুর শিল্প সাহিত্যিক বন্ধু বান্ধবরা উপন্যাসটি নিয়ে তীর্যক সমালোচনা করতে কেউ পিছপা হল না।  কেউ কেউ উপন্যাসিট ’পর্নো’ ছাড়া আর কিছুই মনে করেনি। তাদের উদ্দেশ্যে লরেন্সের মন্তব্য হল,

 ‘নরনারীর শারীরিক সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সম্পর্কটি লজ্জার নয় বরং ঐশ্যর্যের। উপন্যাসটিতে  যখন আমি প্রবেশ করি সেখানে সুন্দরকেই আমি খুজে পাই। আমার কাছে সেখানে সুন্দর আর নবিনতার ছোঁয়া ধরা পড়ে।’

চলুন ঝট করে এক চুমুকে উপন্যাসটিতে ঘুরে  আসি। লেডি চ্যাটার্লি একজন উচ্চ বিত্তে জন্ম নেয়া নারী। তিনি বেশ বুদ্ধিমতী। বিয়ে করেছেন ইংল্যান্ডের অনেক অভিজাত ভুস্বামী এবং ধনকুবের স্যার ক্লিফর্ডকে। কিস্নফর্ড যুদ্ধফেরত ব্যবাসায়ী। শিল্প সাহিত্যেও তার ঝোক। শরীরে খান্দানের ঘ্রাণ মিশিয়ে তার চোখ সবসময় থাকে সমাজের উচ্চ আসনের দিকে। পরবর্তীতে কয়লা খনির ব্যবসাতেও তিনি মন দেন। কিন্তু ক্লিফর্ড পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়ে পরেন। ক্লিফর্ড এর সঙ্গে লেডি চ্যাটার্লির শারীরিক এবং মানসিক দুরত্ব তৈরি হয়। লেডি চ্যাটার্লির অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় ক্লিফোর্ড এস্টেট এর গেম কিপার অলিভার মেলর্স এর সঙ্গে। উপন্যাসটিতে তখন শুরু হয় মনোজগত এবং অন্তজগতের দ্বন্দ। ক্লিফর্ড বনেদি সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ,সমাজের শ্রেণী বিভাজন করে তিনি তার রাজত্ব ধরে রাখতে চান, তিনি শিক্ষিত কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম। অন্যদিকে তার স্ত্রী লেডি চ্যাটার্লি সন্তানের জন্যে লালায়িত, ভালোবাসার জন্যে লালায়িত। কিন্তু ক্লিফোর্ডের পক্ষে তাকে কোন কিছুই দেয়া সম্ভব নয়। ক্লিফোর্ড শুধু শারীরিকভাবেই পক্ষঘাতগ্রস্থ নয়  মানসিকভাবেও। শেষ পর্যন্ত কনি ক্লিফোর্ডকে ছেড়ে মেলর্সের সঙ্গে কানাডা পাড়ি দেন অজানা সুখের সন্ধানে।  অসাধারণ রূপক ব্যবাহর করে ডি.এইচ.লরেন্স তাঁর এই উপন্যাসে পক্ষান্তরে পক্ষাঘাতগ্রস্থ সমাজটিকেই দেখাতে চেয়েছেন।

  বলার অপেক্ষা রাখে না গোটা বিশ্বে  এই উপন্যাসটির  জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে গুরুগম্ভীর পাঠকের হাতে তখন লেডি চ্যাটার্লিজ ঘুরে বেড়ায়। সন্দেহ নেই বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে  ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল সমাজকে প্রবলভাবে এই উপন্যাসটি আঘাত করেছিল। অবশ্য কোন কোন সাহিত্য সমালেচকগণ উপন্যাসটিকে সস্তা, চটুল এবং পর্ণোগ্রাফিতে ঠাসা বলে আখ্যায়িত করেন।  উপন্যাসটি সমাজের উচ্চ তথাকথিত এলিট শ্রেনীর অহংকার এবং শ্রেণী বিভাজনকে ভেংগে চুরমার করে দেয়। সমাজে সুকৌশলে লালিত বৈষম্যকে এই উপন্যাস দিয়ে প্রবলভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। স্বাভাবিকভাবেই  উপন্যাসটি নিয়ে গোটা পৃথিবীর রক্ষণশীল সমাজে প্রবল আপত্তির কারণ হয়ে দাড়ায় এবং উপন্যাসটি প্রকাশ এবং প্রচারে বাধাগ্রস্থ হয়। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। গোটা ইংল্যান্ডে যখন উপন্যাসটি নিয়ে হৈচৈ, যখন কোন প্রকাশকই উপন্যাসটি ছাপতে রাজি হচ্ছিল না তখন বিলেতের বেশ কয়েকটি নামকরা প্রকাশক লরেন্সের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে এল। তারা উপন্যাসটি থেকে ’চারশব্দের’  আপত্তিজনক শব্দটি  বাদ দিতে লরেন্সকে অনুরোধ জানায়। লরেন্স প্রকাশকদের সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বললেন,

 ‘আমি বরং কাচি দিয়ে আমার নিজের নাক কেটে ছটে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু উপন্যাসের কোন শব্দ কাটা যাবে না। নিষিদ্ধ হোক তাতেও কোন আপত্তি নেই।’

আরেকটি বিষয় আলোচনা করা এখানে খুব গুরুপূর্ণ বলে মনে করি। সিগমন্ড ফ্রয়েড যাকে বলেছেন ’মনোযৌন বিকাশ’। এই বিষয়ে মানসিকভাবে আমরা কতটুকু বিকশিত হতে পেরেছি? আমাদের একটি শিশু মন যখন বেড়ে উঠে তখন সেই শিশুটির আত্মায় কি ধরনের বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠে! ফ্রয়েড যেমন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে পাঁচটি যৌন স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন ঠিক একই ভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে সেই স্তরগুলো একটি শিশু কোন রকম সামাজিক বাধা ছাড়াই অতিক্রম করতে পারে কি? ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন মানুষের যৌন বাসনাগুলি যদি অপূর্ণ থাকে তাহলে সে মানুষটির ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য। একজন মানুষ শুধুমাত্র শারীরিক ভাবে বড় হলে বড় হয় না বরং তাকে মানসিক ভাবেও বাড় হতে হয়। কথা হল আমরা মানসিক ভাবে কতটুকু বড় হতে পেরেছি সেই নিয়ে। ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটি নিয়ে এত ফিসফাস হওয়ার কারণ কি তাহলে তাই? কেন আমরা এই উপন্যাসটি এখনো খোলামেলা পরিবেশে পড়তে ভাই পাই? আমাদের যথাযথ ‘মনোযৌন বিকাশ’ হয়নি বলে?

ধর্ম এবং সমাজের কিছু ট্যাবু বা প্রবণতার শেকল থেকে আমরা কখনই মুক্ত নই। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে যৌনতা বিষয়ে কোন শিক্ষা আমরা লাভ করিনা। ছেলেবেলা থেকেই শিখিয়ে দেয়া হয় যে যৌন চিন্তা মানেই পাপ চিন্তাা!! এই ধরনের বাণী আত্বস্থ করেই একটি শিশু বড় হতে থাকে। যে কারণে ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ আমাদের পড়তে হয় গোপনে, বাথরুমে বসে অথবা লাইব্রেরিতে কোন একা একা চুপি চুপি। আর ঠিক একই কারণে ’লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ পড়ে আমরা অবলিলায় বলে দেই যে এটি সস্তা চটুল যৌন সুড়সুড়ি দেয়া কোন উপন্যাস। অথচ দুঃখজন বিষয় হল আমরা কখনো চিন্তুাও করি না বা চিন্তা করার মত সেই মানসিক শক্তিও আমরা ধারণ করি না যে লরেন্স এই যৌনতার আড়ালে সত্যিকারের কি বলতে চেয়েছেন। একটি শিল্পকে ব্যাবচ্ছেদ করার ক্ষমতা আমাদের এখন যেমন নেই ঠিক আজ থেকে ১০০ বছর আগে ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল সমাজেও ছিল না। লরেন্স সমাজের এই অসুখটি অত্যান্ত শিল্পতভাবে তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

বাস্তবতা হলো লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার উপন্যাসটি তৎকালীন সমাজ স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। উপন্যাসটির প্রকাশক পেঙ্গুইনকে আদালতে পর্যন্ত দাড়াতে হয়েছে। আদালতের রায় ছিল, ”উপন্যাসটি ছাপার অযোগ্য”। ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার্স ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬১ সালে প্রথম বিলেতের মাটিতে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। জানা যায় লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের একটি কপি বিলাতের বিচারকের জিম্মায় ছিল। বিচার কাজ চলাকালীন তিনি গ্রন্থটি ব্যাবহার করেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি কিছুদিন আগে ৫৬ হাজার ২৫০ পাউন্ডে অকশনে বিক্রি হয়। অবশ্য বইটির কপি যার সংগ্রহে ছিল তিনি চেয়েছিলেন সেটি ইংল্যান্ডের বাইরে বইটি বিক্রি করে দিতে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বাইরে বইটি যেন কোথাও বিক্রি না হতে পারে সে জন্যে একটা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এই হল শিল্পের কঠির বাস্তবতা! যে গ্রন্থটি বিলেতের মাটিতে নিষিদ্ধ ছিল সেই একই গ্রন্থ আবার অকশনে হাজার হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়ে যায়! এভাবেই হয়তো সময়ের সঙ্গে সমাজটাও বদলায়।

তবে ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটির শত নেতিবাচক সমালোচনার পরেও উপন্যাসটি লরেন্সকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে দিয়েছিল। লরেন্সের সাহিত্যিক বন্ধু কথাসাহিত্যিক রিচার্ড এলডিংটন উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেন ‘বিংশ শতাব্দির টুপিতে এক অসমান্য পালক’। শিল্প সাহিত্যের পত্রিকায় কিছু সাহিত্য সমালোচকদের তীর্যক মন্তব্যের পাশাপাশি অনেকেই বলতে শুরু করেন,‘ কথাসাহিত্যের ইতিহাসে জীবন বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে এমন উপন্যাস অন্যতম উদ্দীপক হিসাবে কাজ করবে।’

জয় লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার!

Leave a Reply