You are currently viewing গ্রন্থঃ একাত্তরের স্মৃতি

গ্রন্থঃ একাত্তরের স্মৃতি

লেখকঃ বাসন্তী গুহঠাকুরতা

প্রকাশকঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

গ্রন্থ আলোচনাঃ আদনান সৈয়দ

গ্রন্থের শুরুতেই লেখক বাসন্তী গুহঠাকুরতা বলেছেন,

‘ আমার চেতনায় “পঁচিশ” মানেই একান্তরের পঁচিশে মার্চের কালো রাত আর “একুশ” মানেই বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনার, যদিও বছরের বারটি মাসেই এ তারিখ দুটো আসে।’

যুদ্ধের শুরুর দিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাকিস্তান বর্বর সেনারা রাতের অন্ধকারে বাড়িতে এসে গুলি করে আহত করে ফেলে চলে যায়। এর মাস খানেক পরই তাঁর মৃত্যু হয়। ‘একান্তরের স্মৃতি’ লেখক বাসন্তী গুহঠাকুরতা বুকের ভেতর জমে থাকা সেই ভয়ার্ত স্মৃতিগুলোকে অকপটে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,

‘এদিকে অফিসারটা একটানে রান্না ঘরের দরজা খুলে স্বর্ণকে কনুই দিয়ে এক ধাক্কায় বাগানে ফেলে বারান্দায় ঢুকে পড়লো। আমি সামনে গেলাম। বললো “ প্রফেসর সাহেব হ্যায়?” মিথ্যা বলে লাভ নেই। বললাম, “হ্যায়।” ও বললো, “ উনকো লে যায়গা।”

‘একাত্তরের স্মৃতি’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো বলা বা লেখা হয়তো সহজ কিন্তু যাঁরা এই বাস্তবতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা ঠিক জানেন সেই সময়কে সঠিকভাবে তুলে এনে কলমের কালিতে রূপান্তরিত করা যে কত কঠিন। এই গ্রন্থটি পড়ার পর মনে হয় লেখক যেন সেই কঠিন কাজটিই সম্পন্ন করেছেন।

স্মৃতিকথা মানেই একটি সময়ের ইতিহাস। আর সে স্মৃতিকথা যদি হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ আর সেই স্মৃতিচারণটি যদি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শহীদ অধ্যাপক ড: জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা তখন সেই গ্রন্থটির গুরুত্ব যে অনেক সেটি সহজেই অনুমেয়। বাসন্তী গুহঠাকুরতার নিজেরও একটি বর্ণময় পরিচিয় আছে। তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে ছিলেন। নানা রকম সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাজকর্মেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন। লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মৃতুপথযাত্রী স্বামী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার অনুরোধে। মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে তিনি বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে বিশেষ অনুরধ করে বলেছিলেন তিনি যেন সত্যিকারের একটি ইতিহাস লেখায় হাত দেন। বাসন্তী গুহঠাকুরতা লিখেছেন,

‘ ১৯৭১ সালের কালো রাতে একজন পাকিস্তানী সেনা অফিসার সদল বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে প্রবেশ করে  এবং আমার স্বামী জগন্নাথ হলের প্রভোষ্ট ড: জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে নির্মমভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বাসার সামনেই গুলি করে এবং তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে যায়। জ্যোতির্ময় তখনই মারা যাননি। তাঁর ঘাড়ে গুলী করা হয়। সর্বাংগ অবশ হয়ে শুধুমাত্র কথা বলার মতো ক্ষীণ শক্তি নিয়ে মৃত্যুু শয্যায় তিনি আরো কয়েক দিন শায়ত থেকে ৩০শে মার্চ পরপারে পড়ি জমান। মৃত্যু শয্যায় আমার প্রতি তাঁর একটি বিশেষ অনুরোধ ছিল আমি যেন ইতিহাস লিখি।’

বাসন্তী গুহঠাকুরতা তাঁর স্বামীকে দেয়া কথাটি রেখেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস লেখায় হাত দিয়েছিলেন। সেই দিক বিবেচনা করলে এই গ্রন্থটি তঁর স্বামীকে দেয়া অনুরোধেরই একটি ফসল। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ১৮ বছর পর সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক আবুল হাসনাতের অনুরোধে সংবাদের সাহিত্য পাতায় তিনি ধারাবাহিকভাবে একাত্তরের রক্তাত্ব স্মৃতি জার্নাল লিখতে শুরু করেন। লেখাটি পাঠক প্রিয়তা পায়।

১৬২ পৃষ্ঠার গ্রন্থ। পৃষ্ঠা হিসেব করলে খুব একটা দীর্ঘ গ্রন্থ এটি নয়। কিন্তু লেখার গভীরতা এবং ব্যাপকতার দিক থেকে এই গ্রন্থটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। রাজনীতি, সমরনীতি তো আছেই সেই সঙ্গে এই গ্রন্থে উঠে এসেছে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। যুদ্ধকালীন একটি রাষ্ট্রে একদিকে চলছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীদের অত্যাচার অন্যদিকে চলছে লুটপাট, অপহরণ। নয়টি মাসের খন্ডচিত্র উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে সেই দুঃসময়ের কিছু বাস্তব গল্প। মানুষের গল্প, নর পশুদের গল্পের পাশাপামি তিনি একটি সামান্য আসবাবপত্রের গল্প দিয়েও তৎকালীন একটি সমাজকে এই গ্রন্থে এঁকেছেন। এই গল্পগুলো পাঠ আমাদের সবার জন্য খুব জরুরী। লেখক বলছেন,

‘ভাবলে এখনও হাসি পায়। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসবাবপত্রগুলোও রিফিউজির মত পালা বদল করে। আমাদের সুখ-দুঃখ, ভয়ভীতি আছে। আমরা ভয়ে আস্তানা বদল করি। কিন্তু আসবাবপত্রগুলোর পায়া থাকলেও স্থান পরিবর্তন করতে পারে না। চোর ডাকাতরা ওদের লুটে নিতে পারে।’

শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো ৭১ এর লক্ষ শহীদদের আমরা কখনো ভুলবো না। আমাদের নতুন প্রজন্মদের জন্য এই গ্রন্থটি পাঠ জরুরী।

গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন হাবিবুর রহমান

Leave a Reply