You are currently viewing গ্রন্থ আলোচনা

গ্রন্থ আলোচনা

গ্রন্থঃ বাংলার চালচিত্র

লেখকঃ আবদুল জববার

প্রকাশকঃ মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, ইন্ডিয়া

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আদনান সৈয়দ

এমন কিছু গ্রন্থ আছে যা বার বার সময়ে অসময়ে পড়া যায়। অনেক সময় গ্রন্থটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেও অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে মনে পড়ে যায় গ্রন্থটির সাথে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিকথা। প্রথম স্পর্শ, পাতার ঘ্রাণ। পাতা ভাঁজ করে রেখে ঘুমতে যাওয়া তারপর আবার সেই ভাঁজ করা পাতার শিরদাড় সোজা করে আবার গ্রন্থের ভেতর নিজেকে সিধিয়ে দেওয়া। বই পড়ার নেশা থাকলে এসব বিষয় আমলে দিতে হয় বৈকি! অনেকদিন পর আবার আবদুল জববার রচিত তাঁর বিক্ষাত গ্রন্থ  ‘বাংলার চালচিত্র’টি আবার পড়লাম। আবার সেই একই অভিজ্ঞতা। কল্পনায় কিছু চরিত্র যেন প্রতিনিয়ত বুক খামছে ধরে রাখে। তাদেরকে কোনভাবেই তাড়াতে পারি না। এড়াতেও পারি না।

‘বাংলার চালচিত্র’ শিরনামটি ’দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের দেওয়া। আমরা সবাই জানি সাগরময় ঘোষ শুধু পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন না তিনি পাকা জুহুরীর মত লেখকও আবিস্কার করতেন। আবদুল জববারও ঠিক তারই এক আবিস্কার। ধারাবাহিক এই লেখাটি ‘দেশ’ পত্রিকায়  ১৯ জুলাই ১৯৬৯ সাল থেকে ২৫ এপ্রিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত  টানা ছুটে চলেছিল। এই এক বছরেই ‘বাংলার চালচিত্র’ পাঠক সমাজে বিশেষ এক মনযোগ আকর্ষন করতে সমর্থ হয়েছিল। লেখক আবদুল জববার নিজের সম্পর্কে ভুমিকায় বলছেন, “ আমি ভূমিহীন কৃষক ও কারখানা-শ্রমিকের ঘরের সন্তান, সুখে-দুঃখে আজো আমি তাদের কোলেই রয়েছি।তাদের যেমন দেখেছি, জেনেছি,কোন রঙ না চড়িয়ে নির্ভেজালভাবেই চিত্রিত করছি।’

ভুমিকায় লেখকের স্বগতোক্তি পড়েই অনুমান গ্রন্থটি সম্পর্কে ধারনা করতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। লেখকের ভাষায়, ‘তথ্যভিত্ত্বিক রচনার মধ্যে গল্পের আকারে আমি জলজ্যান্ত মানুষ এনেছি, চরিত্র এনেছি- এরা গাঁয়ের মানুষ, ক্ষেত-খামারে, কলে-কারখানায় কাজকরা অন্ধকারের প্রাণী।’

২৬৫ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন অসাধারণ সব ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে। আমাদের গ্রামীন জীবনের আখ্যান শুধু বলবো নয় সেখানে বিভিন্ন চরিত্রকের কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ এক সাহিত্য রস। যে সাহিত্য রস বাংলা সাহিত্যেতো বটেই গোটা বিশ্বের সাহিত্য ভান্ডারের জন্যে এক অনন্য সম্পদ। দু একটি ‍উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই গ্রন্থের প্রতিটা চরিত্র আমাদের খুব কাছ থেকে চেনা। আমরা চোখ বুজলেই তাদের দেখতে পাই,ধরতে পাই, তাদের পাশে বসে হেড়ে গলায় তক্ক করতেও বাধে না। কারণ তারা আমাদেরই একজন। প্রতিটা চরিত্রই যেন খুব বাস্তব। নীচে কিছু নমুনা দিলাম।

‘রাতের মোহিনীরা রাত নামবার আগেই দু-এক টাকা কামবার লোভে মুখে ছাইপাঁশ মেখে শুঁড়িখানার পাশে ‍বুক চিতিয়ে খুঁটি হেলান দিয়ে চোখের কিংবা হাতের ইংগিতে অনুনয় বিনয় সহকারে আহ্বান করে। নগেন জলিল মোল্লার দাড়ি ধরে চুমু খেয়ে বলে, ‘মামু গো, মোর মাসি তোমাকে ডাকছে,’শরীল’ শেতল আর হালকা করে এস!’(গরুহাটা বিবিরহাটঃ উলুবেড়িয়া, পৃষ্ঠা-৩)

‘একদিন ছিল আমার তালপাতার কুঁড়ে। বর্ষাকালে মাটি কাদার মেঝে থেকে কেঁচো উঠত। বুড়ি মা ভিজে জুজড়ি হয়ে বকের মতন বসে থাকত সারা রাত জেগে। একটা ছাতা ছিল না। ছিল না একটা ‘হেরকেন’। মা পরের বাড়ি ঢেঁকি ঠেঙিয়ে যে এক-আধ মুঠো ‘খুদ’ পেত তার জাউ খেয়ে কলে যেতুম।’( শ্যমগঞ্জের বড় সরদার, পৃষ্ঠা-১৭)

 “পাড়ায় পাড়ায় সুতোর দোকান। মনিহারি আর মিষ্টির দোকান। গোশত দোকান। খড়ম পায়ে দর্জিরা চলছে এ-দলিজ থেকে ও-দলিজে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফিরছে মাদ্রাসা থেকে। দর্জেদের বাড়ি ঘরদোর ঘেরা। পুকুরঘাট ঘেরা ছামাড় দিয়ে। নারীরা এখানে ‘অসূর্যস্পর্শা।’(দর্জিপাড়া মেটিয়াব্রুজ, পৃষ্ঠা-৪৫)

 ‘হালিমার লাস আর সদরে চালান গেল না। কাফন দাফনের হুকুম পাওয়া যেতে আবার মোল্লা সাহেবকেই ডাকতে হল। একটা মুরগী জবাই করতে গেলে মোল্লাকে চাই; সবে-বরাতের সময় মৃত আত্বীয়স্বজনের আত্মার মুক্তির জন্যে কোরআন শরীফ আর মাদুরী বগলে করে বাড়ি বাড়ি আসেন, সরবত খান, দুচার আনা পয়সা নেন-তাকে চটালে বাড়ির ফাঁক দিয়ে অন্য বাড়িতে পড়তে চলে যাবেন মোল্লা সাহেব। বিয়ে পড়ানোর সময় তাকে চাই, চাই মৃতের ‘জানাজা’ পড়াবার সময়।’ (মোল্লা এবং মল্লিক সাহেব, পৃষ্ঠা-১১৮)

 ‘টিকোল নাক। ফরসা রঙ। চোখ ‍দুটি যেন পদ্ম-পলাশের পাপড়ি। মধুর-একেবারে মিহি,মোলোয়েম,বিনয়ী গলার স্বর। সঙ্গে দুটি লব কুশ। যেন রামায়ণ গান গাইতে  এসেছেন নগরবাসীদের দুয়ারে। কান করে শুনলাম। শুনে আমি মুগ্ধ হলাম। মেদেনীপুরের ফকির। গার গাইছেন। অপূর্ব গলা। দোয়ারকী গাইছে দুটি নওলকিশোর।’(মেদেনীপুরের ফকির,পৃষ্ঠা-২৪৭)

 গ্রন্থট সম্পর্কে শ্রী সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আপনার লেখায় আমাদের এই সুখদুঃখময় জীবনের যে ছবি ফুটে উঠছে, সততায় আর শক্তিতে সেটা আমার কাছে অতুলনীয় লেগেছে।আপনি নিজে যা মনে করেন, সেটুকু স্পষ্ট করে জোরের সঙ্গে বলতে আপনার দ্বিধা বা সংকোচ নেই- এর মুলে আছে আত্মসম্মানবোধ। আমি নিজে তিন-পুরুষে’ কেরানী ঘরের ছেলে, গরীব মধ্যবিত্ত পরিবেশে মানুষ, মোতীশীলের ফ্রি ইস্কুলে আট বচ্ছর করে আমরা চার ভাই পড়েছি- জুতোর অভাবে খালি পায়ে, ছাতার অভাবে বর্ষায় স্লেট মাথায় দিয়ে ইস্কুলে গিয়েছি। লোকে অনেক সময় ছেলেবেলার কথা ভুলে যায়। যাইহোক, আপনি মানুষকে বড় করেই দেখেন-নিজের আত্মসম্মান আছে বলে অপরকেও তার প্রাপ্য সম্মান দিতে আপনার আটকায় না।’

গ্রন্থটি সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের আরেক ওস্তাদ সৈয়দ মুজতবা আলীর মন্তব্য

 ‘আগেই ’দেশ’ পত্রিকায় আপনার রচনা পড়ে তাজ্জব বনে  গিয়েছিলাম।মাটি থেকে উৎসারিত আপনি, কবিগুরু যা আকাঙ্খা করেছিলেন। আপনার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। লেখবার ক্ষমতাও।’

যারা এই সকাল সন্ধ্যা কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছেন অথবা এই ঝারবাতির চার দেয়ালে বন্দী দশা থেকে কিছুক্ষনের জন্যে মুক্তি চান, তাদেরকে বলবো ‘একটু জিড়িয়ে নিন। এক ছিলিম তামাক বানিয়ে এক সন্ধ্যায় গ্রন্থটি নিয়ে একটু বসুন।’

Leave a Reply