You are currently viewing হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী

হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী

লেখকঃ হুমায়ূন কবির

প্রকাশকঃ সময় প্রকাশন

পাঠ প্রতিক্রিয়া আদনান সৈয়দ

বেশ অনেকদিন পর একটি ভালো যুতসই বই হাতে এলো। ভালো এ কারণেই বললাম যে বইটি পাঠে মনের গভীরে কোথায় যেন একটি আলোড়ন খুঁজে পেলাম। সেই আলোড়নে খানিক আলো দেখতে পেলাম আবার অন্ধকারও দেখতে পেলাম। আলো আসছিল আশা থেকে। আশার আলো থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে। আশা আছে বলেইতো জীবন বহমান! গ্রন্থটি কিছু আশার আলো ছড়িয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আবার অন্ধকারের দেখাও পেলাম। দেখে উদ্বিগ্ন হলাম যখন লেখক দেখালেন কীভাবে হলুদ সাহিত্যে দাগ লেগে আছে লেখক সাহিত্যিকদের কলমের ঠোটে। এটি ভয়াবহ! শিল্প-সাহিত্য চর্চার একটি অন্ধকারতম অধ্যায়।

‘হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী’ একটি প্রবন্ধের বই। গ্রন্থটিকে মোট ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগের নাম হল সাহিত্য। এই ভাগে দুটো প্রবন্ধ রয়েছে। ১) হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী। ২) অভিবাসী সাহিত্যঃ উত্তর উপনিবেশিক সাহিত্যের নতুন অধ্যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বইটির নাম করণ হয়েছে এই প্রথম ভাগে যুক্ত প্রবন্ধ হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী থেকেই। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে চিন্তা। এখানেও প্রবন্ধ দুটো। ১) সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা ২) মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আপেক্ষিকতা। তৃতীয় ভাগ হল ভাষা। এখানে প্রবন্ধগুলো হল ১) গুহালিপি থেকে  প্যাপরাস, ছাপাখানা থেকে সামাজিক মাধ্যম এবং ২) ভাষার বিবর্তনঃ উপনিবেশ ও আধিপত্যের প্রভাব। এবং শেষ অর্থাৎ চতুর্থ বিভাগ হল মহামারি ও যুদ্ধ। এই বিভাগে দুটো নিবন্ধ রয়েছে। ১) যুগে যুগে মহামারি ও পৃথিবীর পরিবর্তন এবং ২) ‍যুদ্ধ ও বাণিজ্য।

‘হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী’ গ্রন্থে যুক্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ এবং এই প্রবন্ধটির নাম অনুসারে গ্রন্থটির নামকরণও খুব প্রাসঙ্গিক হয়েছে বলে আমি মনে করি। কথা হল কেন এই প্রবন্ধটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কারণ হল বর্তমান এই ডিজিটাল দুনিয়ায় হলুদ সাহিত্যে ছয়লাব হয়ে গেছে। নানা জায়গা থেকে টুকে দিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দাওয়া এখন রীতিমত চর্চায় পরিনত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে অনেক লেখকরাই জেনে বা না জেনে বিভিন্নভাবে এই ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন। লেখক তাঁর এই প্রবন্ধে হলুদ সাহিত্যের ইতিহাস থেকে শুরু করে হলুদ সাহিত্যের সংজ্ঞাটিও নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি তিনি হলুদ সাহিত্য নিয়ে দলবাজি, পুরস্কার, সাহিত্যের সংকীর্ণতার নানা পথের কথাও বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন একজন লেখককে কীভাবে পেশাদারী মন নিয়ে তার কাজটি করে যেতে হয়। দলবাজি করা একজন লেখকের কাজ নয়। একজন লেখকের কাজ শিল্পকে নির্মাণ করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই দলবাজ লেখকদের সংখ্যাও কম নয়! লেখক বলেছেন,

‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সমাজের  সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা,অনিচ্ছা-সবই সাহিত্যে প্রতিভাত হোক, এমনটাই হওয়া উচিত। মানুষের দলবদ্ধতা এই অনুধাবনের বিপরীত নয়। কিন্তু একজন দলবাজ-সাহিত্যিকের দলকানা স্বভাব তাকে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অনিরপেক্ষ করে তোলে।’ লেখকের সঙ্গে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। বর্তমান সময়ের লেখক সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সাহিত্য সম্পাদক পর্যন্ত সর্বত্রই রয়েছে উগ্র দলবাজি চর্চা। এই ভয়াবহ চর্চায় শুদ্ধ সাহিত্য চর্চার অবকাশ কোথায়?

এই গ্রন্থে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হল ‘অভিবাসী সাহিত্যঃ উত্তর উপনিবেশিক সাহিত্যের নতুন অধ্যায়’। আমার কাছে এই প্রবন্ধটি নানা দিক থেকেই খুব মূল্যবান মনে হয়েছে। একেতা আমি নিজেই অভিবাসীদের দলে পরি। অভিবাসী লেখকদের মনের খবর কিছুটা হলেও টের পাই। কারণ আমি নিজেও অভিবাসী সাহিত্য নিয়ে কাজ করি। লেখক হুমায়ূন কবীর নিজেও অভিবাসী জীবনকে বেছে নিয়েছেন। পেশায় তিনি ডাক্তার কিন্তু মনে প্রাণে তিনি একজন বাংলা শিল্প-সাহিত্যের কারিগর। ঘুংঘুর নামে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকও তিনি। সুতরাং অভিবাসী লেখকদের নানা ধরনের কাজের সন্ধান তিনি তাঁর  এই প্রবন্ধে দিবেন এই স্বাভাবিক। তিনি ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়েও গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং কোন কোন সাহিত্যকে ডায়াসপোরা সাহিত্য বলা যেতে সে বিষয়ে চিহিৃত করেছেন। ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে আমার দুটো কথা আছে। এই নিয়ে আমি আগেও কিছু লিখেছিলাম। প্রথম কথা হল আমরা এখন ডিজিটাল দুনিয়ার বাসিন্দা। বাংলাদেশে কোন কবি যখন কবিতা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেন তখন আফ্রিকার আদ্দিস আবাবায় বসে আরেক বাঙলি হুকো টানতে টানতে সে কবিতটি পড়তে পারেন। কথা হলো যে কারণে ডায়াসপোরা সাহিত্যের জন্ম এখন মানুষ সেই অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাড়িয়েছে। তবে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই উন্মুল। তারা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে থাকে তার ভাষা, সংস্কৃতি আর দেশটাও। যেকারণে একজন লেখক যখন উন্মুল হয়ে উঠেন তিনি কিন্তু তার মূল থেকে কখনো বিচ্যুত হতে পারেন না। সেই হিসাবে তার সাহিত্য ডায়াসপোরা সাহিত্য হতে বাধ্য। তবে বর্তমান দুনিয়ার হিসাব নিকাশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, ভৌগলিক অবস্থানসহ নানা বিষয় হয়তো ডায়াসপোরা শব্দটির অর্থ খানিক পরিবর্তন ঘটাতেও পারে।

  কালি ও কলম থেকে ছাপাখানার ইতিহাস এবং ছাপাখানা থেকে মানুষের এই কীর্তি কীভাবে সামাজিক হাতিয়ার হয়ে উঠলো সেই নিয়ে আলোকপাত করেছেন ‘গুহালিপি থেকে প্যাপিরাস, ছাপাখানা থেকে সামাজিক মাধ্যম’ এই প্রবন্ধে। ‘যুদ্ধ ও বাণিজ্য’ নিয়ে তাঁর প্রবন্ধটিও পাঠকদের মনের অনেক প্রশ্নের সমাধান দিবে বলে আমার বিশ্বাস। এই প্রবন্ধে লেখক গ্রন্থে যুক্ত তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধগুলো সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থটির পাঠকদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াক সেই প্রার্থনা করি।

তবে গ্রন্থটি নিয়ে একটি শেষ কথা। আমার ধারণা ছিল এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি শুধুমাত্র হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী বিষয়টিকে ঘিরেই। আর এই বিষয়কে নিয়ে গোটা আস্ত একটি গ্রন্থ যদি পাঠক আশা করেন তাহলে সেটি খুব অমূলক হবে না।

গ্রন্থটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। পাওয়া যাবে সময় প্রকাশনীতে । আর অনলাইন বইয়ের দোকান রকমারি ডটকমেও। গ্রন্থটির পাঠক প্রিয় হোক এই কামনা।

হেপি রিডিং।

Leave a Reply